• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘চ্যালেঞ্জ নিতে শিখতে হবে’


অরণ্য সৌরভ মার্চ ৭, ২০২১, ০৩:৪৮ পিএম
‘চ্যালেঞ্জ নিতে শিখতে হবে’

ঢাকা : এক সময় নারীরা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা ভাবতেই পারত না। কিন্তু সময় এখন পাল্টে গেছে। এখন সময় সেই আবদ্ধ ঘরে বাস করা নারীদেরও। নারী এখন কৃষি মাঠ থেকে আকাশে পর্যন্ত ডানা মেলে উড়তে শিখেছে। নেতৃত্ব, বিজ্ঞান, খেলাধুলা, আবিষ্কার, বিপ্লব, বিদ্রোহ, রাজপথ, এমনকি আকাশও পাড়ি দিচ্ছে অকুতোভয় সৈনিকের মতো। দায়িত্ব নিয়ে। শুধু এখানেই নারীরা থেমে থাকেনি। অবলীলায় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডও চড়ে বেড়াচ্ছেন।

পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে তুলে ধরছেন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবন ও যাপনের গল্প। তেমনই এক নারী, একজন অনন্যা এলিজা বিনতে এলাহী। ঐতিহ্যের সন্ধানে দেশের ও দেশের বাহিরের নানা পথপ্রান্ত ঘুরে বেড়ানো এলিজা নিজের পরিচয় দেন ‘ঐতিহ্য পর্যটক’ হিসেবে।

তিনি কখনোই জীবনযাপন করতে চাননি, চেয়েছে সব সময় জীবনকে উপভোগ করতে। তিনি জীবনকে প্রকৃতির এক মূল্যবান উপহার মনে করেন। সেখান থেকেই উপভোগ করার চিন্তা মাথায় আসে। আর তার কাছে উপভোগের মাধ্যম ভ্রমণ।

নারী হয়ে ভ্রমণে বের হওয়ায় কিছু বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। শুরুতে পরিবার ও সমাজ থেকে বাধা আসলেও ভ্রমণের মূল বিষয়টা বোঝাতে পেরেছেন বলেই বাধা অতিক্রম করাটা সহজ হয়েছে বলে মনে করেন এলিজা। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরে বেড়ানো, স্থাপনাগুলোর তথ্য, ভিডিও ও স্থিরচিত্র সংগ্রহ করে বিশ্ব দরবারের কাছে দেশকে তুলে ধরাই তার প্রিয় কাজ। তিনি ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রিয় একজন নারী।

এ ছাড়া তিনি একজন গবেষক, বিশ্ব পরিব্রাজক এবং শিক্ষকও। চষে বেড়িয়েছেন পুরো বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে নেপাল ট্যুরের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ শুরু করে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণ করে এসেছেন। ছোট থেকেই ভ্রমণপিপাসু এলিজা বলধা গার্ডেন থেকে ২০১৬ সালের ১৭ মে শুরু করেছিলেন বাংলাদেশে হেরিটেজ ভ্রমণ।

২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট শেষ হয় ৬৪ জেলার হেরিটেজ জার্নি। এখন দ্বিতীয় ধাপে আবারো পুরো দেশ ভ্রমণে পথে পথে ঘুরছে এলিজা। এলিজা ছোট থেকেই ইতিহাসপ্রেমী, প্রত্নতত্ত্ব অনুরাগী। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো তৈরির পেছনের মানুষের ভাবনা ও কারিগরদের দক্ষতা-কুশলতা তাকে শুধু মানুষের সীমাহীন ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি মনে করেন, মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই, শুধু স্বপ্ন দেখতে হবে। তার পড়াশোনার বিষয় ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ব না থাকার পরও নিজের ইচ্ছার তাগিদে প্রফেসরদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে শখের বিষয়কে পড়াশুনার সাথে সম্পৃক্ত করেন।

তার ভাষ্যমতে, প্রতিটি নতুন শহর এক একটি নতুন প্রেমের মত সুন্দর। তিনি যে-কোনো নতুন শহরের প্রেমে পরে যান। শুধু যে বিদেশের শহরগুলোকেই এমন মনে হয় তা নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা শহরও একই অনুভূতি দেয় তাকে।

এলিজা বলেন, স্বপ্নের পথে হাঁটতে গেলে চ্যালেঞ্জ নিতে শিখতে হবে। আমার জীবনটা আমার, এ জীবনের পুনর্জন্ম হবে না। তাই নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে, জীবনকে যাপন না করে উদ্যাপন করতে হবে। জামালপুরের ইসলামপুরে জন্মগ্রহণ করলেও বেড়ে উঠেছে ইট-পাথরের শহর ঢাকায়।

ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন, এআইইউবি থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। এছাড়া নেদারল্যান্ডসের হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশনে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে হেরিটেজ ট্যুরিজমের গুরুত্ব’ বিষয়ে গবেষণা করেন। ২০১৮ সালে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসেন।

এলিজা বিনতে এলাহী বলেন, পর্যটন এমন একটা শিল্প যেখানে গ্রামের একজন অসহায় অক্ষরজ্ঞানহীন নারীও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় এমন অভিজ্ঞতাই হয়েছে। গৃহিণী নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যোগাযোগ করার মতো ভাষা রপ্ত করে ভ্রমণে গাইড হিসেবে নিজেদের যুক্ত করেছেন। আমি মনে করি, আমাদের দেশেও এমনটা হতে পারে। আমাদের দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আমাদের অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্থাপনা, প্রত্নতত্ত্ব রয়েছে।

যেগুলোকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারলে, তরুণদের এসব ইতিহাস ঐতিহ্যসংবলিত স্থানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারলে দেশে পর্যটন অর্থনৈতিক খাতেও এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
তিনি বলেন, আমি চাই মানুষ পর্যটনের পথে আসুক। এ পথে সমৃদ্ধি আছে। একটা গ্রামে যখন কয়েকশ বছরের পুরনো একটা স্থাপনাকে সংরক্ষণ করা যায়, আর সেটিকে যখন মানুষের কাছে তুলে ধরা হবে মানুষ তখন সেটা দেখতে আসবে। পর্যটকের আনাগোনা বাড়লে সেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ হবে। আর এভাবে সেখানকার অর্থনীতির চাকা সচল হবে।

হেরিটেজ ট্যুরিজম নিয়ে এলিজার অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ৬৪ জেলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছবি ও তথ্য-উপাত্তসহ সহজ ভাষায় একটি বইয়ে লিপিবদ্ধ করতে চায়। যেন মানুষ একটি বইয়ে হাত দিয়েই প্রতিটি জেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জেনে ভ্রমণে উৎসাহিত হয়। এছাড়া অল্পস্বল্প করে হেরিটেজ ট্যুরিজম সম্পর্কিত নানান কাজ করছে।

বছরের যে-কোনো একটি দিন যেন হেরিটেজ ট্যুরিজমের জন্য ধার্য করা হয়, তেমন একটি দিন বা দিবস হোক সেটাও এলিজার জোর দাবি। পুরো দেশে যখন জাতীয়ভাবে হেরিটেজ ট্যুরিজম দিবস পালিত হবে তখন সর্বস্তরের মানুষ এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে বলেই মনে করে এই ভ্রমণকন্যা। বাংলাদেশকে যদি হেরিটেজ ট্যুরিজমের আওতায় আনা যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি অনেকটা এগিয়ে যাবে বলেও মনে করেন এলিজা বিনতে এলাহী।

এছাড়া এলিজার ইচ্ছা দেশের প্রতিটা জেলায় একটি করে হেরিটেজ ট্যুরিজম দল গঠন করার। অনেকটা দুঃখ বা ক্ষোভ নিয়েই এলিজা বলেন, আমরা ছুটি পেলেই চলে যাই সুন্দরবন, পাহাড়ি এলাকা চট্টগ্রাম বা সাগরে টানে চলে যাই সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার।

কিন্তু পরিবারের ছোট সদস্যদের নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কুমিল্লার ময়নামতি, সোনারগাঁও জাদুঘর, পুরান ঢাকা আহসান মঞ্জিল, কুষ্টিয়ার লালন বাড়িতে। মোটকথা পুরো দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঐতিহ্য-প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে।

যেখান থেকে ইতিহাস, ঐতিহ্য, দেশ সম্পর্কে জানা যাবে। বিদেশে ঘুরতে গেলে প্রথমে চোখে পরে তাদের আইনকানুন। কারণ তাদের ট্যুরিজদের জন্য সাহায্য কেন্দ্র আছে। যেখান থেকে ট্যুরিজরা সব রকমের সাহায্য নিতে পারে। আর তাদের দেশে ট্যুরিজম গাইড আছে যাতে সহজে ট্যুরিজদের পাশে থাকা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে তেমন কিছুই নেই বলে মনে করেন এলিজা। দেশের আনাচে-কানাচে শতশত বিলবোর্ড দেখা যায়।

কিন্তু কোনো বিলবোর্ডদেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলো সম্পর্কিত ছবি, তথ্য কিছুই নাই। যদি বিভিন্ন বিমানবন্দর, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, বিভিন্ন হাইওয়ে বা জেলা শহরের প্রবেশ পথে দেশের বা জেলার ঐতিহাসিক স্থান, বিখ্যাত খাবার-দাবারসহ তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কিত বিলবোর্ড থাকত, তাহলে দেশ এবং দেশের বাইরের মানুষ সহজেই সেখানে ভ্রমণে উৎসাহিত হতো বলে মনে করেন ভ্রমণকন্যা এলিজা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!