• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী

একজন আজন্ম মুক্তিযোদ্ধা


সিরাজুম মুনিরা মার্চ ২৮, ২০২১, ০৩:৩৫ পিএম
একজন আজন্ম মুক্তিযোদ্ধা

ঢাকা : ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সংঘটিত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এদেশের দামাল যোদ্ধারা যখন বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরে এলেন, তখন তাদের আমরা বরণ করে নিয়েছিলাম ফুলেল সংবর্ধনা ও ভালোবাসায়। তাদের বীর উপাধি দেওয়া হয়েছিল, সম্মান দেওয়া হয়েছিল, সমাজেও তারা অর্জন করেছিলেন বিশেষ স্থান। কিন্তু ঘরে ফেরা যোদ্ধাদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে ঘরে তুলে নেওয়া হলেও এই যুদ্ধে যে দুই লাখ মা-বোন হারিয়েছিলেন তাদের সম্ভ্রম, হারিয়েছিলেন সর্বস্ব, তাদের এ সমাজ কোনো সম্মানই দেয়নি। বরং তাদের বর্জন করা হয়েছিল সমস্ত সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান থেকে, আড়ালে রাখা হয়েছিল সমস্ত ভালো কাজ থেকে।

১৬ ডিসেম্বর সবার যুদ্ধ যখন শেষ, এই মানুষগুলোর জন্য তখন আরেকটি যুদ্ধ শুরু হলো। সেই যুদ্ধে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠল চেনা মানুষগুলো; আত্মীয়স্বজন, এমনকি নিজের পরিবার। সেই যুদ্ধে কেউ ঘর হারাল, কেউ স্বাভাবিক জীবন হারাল, আর কেউ কেউ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে আত্মাহুতি দিল। দীর্ঘ ত্রিশ বছর সম্ভ্রম হারানোর লজ্জায় কুঁকড়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে, নিজেকে অবহেলিত ও পরিত্যক্ত ভেবে দিন পার করতে করতে একদিন এই নারীর ভেতর আবার জেগে উঠল পনেরো বছরের সেই স্বাধীনচেতা সত্তাটি। তবে এবার আর ঘর পালাতে নয়, সবাইকে জানিয়ে দিতে যে এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব তারও ত্যাগের ফসল। আর তার এই গল্প শুধু তার নিজের গল্প না, তাদের এই গল্প এই দেশের গল্প, এদেশের দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগের গল্প।

তবে এর ফলাফল যে খুব একটা সহজ হবে না তা তিনি জানতেন। তিনি এটাও জানতেন, এর ফলে হারাতে হতে পারে আবার নতুন করে সবকিছু। এমনকি সেই হারানোর তালিকায় থাকতে পারে নিজের পারিবারও। তবুও পিছপা হলেন না তিনি। কেননা তিনি অনুভব করেছিলেন এদেশের জাতীয় পতাকা যোদ্ধাদের রক্তের পাশাপাশি যে বীরাঙ্গনাদেরও সম্ভ্রমের ফসল তা সবার জানা উচিত। সেই লক্ষ্যেই দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর ১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে তিনি জাতির সামনে তুলে ধরলেন তার সম্ভ্রম হারানোর গল্প, তার ওপর পাকসেনাদের চালানো অবর্ণনীয় নির্যাতনের কথা। হয়তো ভাবছেন, কে সেই সাহসী নারী? কে সেই বীরাঙ্গনা? গলায় বাহারি মালা, কপালে লাল-সবুজের পতাকা অঙ্কিত টিপ পরিহিত সেই নারীর নাম ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।

বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় তার নানার বাড়িতে। তার বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক ছিলেন খুলনার দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক এবং মা রওশন হাসিনা ছিলেন একজন প্রগতিশীল নারী। নানাবাড়িতে এক শৈল্পিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠছিলেন তিনি। নানার বাড়িতে স্বাধীন ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে মুক্ত হরিণীর মতো ছুটে চলা প্রিয়ভাষিণী বাবার কাছে এসে বিবিধ শাসন ও নিয়মকানুনের বেড়াজালের সম্মুখীন হন। আর যেন বাবার কড়াকড়ি মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি।

পরিবারের কড়াকড়ি থেকে মুক্তি পেতে মাত্র ১৫ বছর ৬ মাস বয়সে একদিন প্রেমিককে বিয়ে করে বসেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল প্রিয়ভাষিণীর। কেননা তিনি ধরেছিলেন ভুল মানুষের হাত, যে মানুষটি কিশোরী প্রিয়ভাষিণীকে ভালোবাসার বদলে দিয়েছিল শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। ততদিনে তার ঘরে এসেছে ঐ ভুল মানুষটির ঔরসজাত তিন তিনটি সন্তান। ভুল মানুষটির প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও ভালোবাসার পুরোটা জুড়ে তখন তার সন্তানরা। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়ে ওঠে না। অবশেষে ১৯৭১ সালে ভেঙে যায় তার সংসার।

স্বামীর সাথে সংসার ভেঙে যাওয়ার পর প্রিয়ভাষিণী ভাবলেন, এবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন। নিজ হাতে জীবনকে তিনি সাজাবেন, গোছাবেন ও রাঙিয়ে তুলবেন। কিন্তু হায়, ভাগ্য যেন এবারো প্রতিকূলে ছিল তার। একবার জীবন সাজাতে ধরেছিলেন ভুল মানুষের হাত, আর এবার যখন জীবন সাজাবেন বলে স্থির করলেন তখন জাতির জীবন টালমাটাল! বাতাসে লাশ ও বারুদের গন্ধ মাখামাখি, বিপন্ন মানবতা, অধিকার আদায়ের দাবিতে গর্জে উঠেছে বাঙালি।

এটি ছিল অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। একদিন রাত তিনটার সময় হঠাৎই তার দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত মেয়েটি এসে তাকে জানায়, পাকবাহিনী তার বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। ধর্মের নামে যুদ্ধে নামা অমানুষগুলোর অধিকাংশই সেদিন ছিল মদ্যপ। পাকবাহিনীর দুই দোসর হত্যার মিথ্যা অভিযোগে ওরা নিয়ে চলে গেল প্রিয়ভাষিণীকে। গাড়িতেই সেদিন পাকবাহিনীর হাতে গণধর্ষণের শিকার হলেন তিনি। প্রিয়ভাষিণীর আর্তনাদে সেদিন ওদের মন গলেনি। হায়েনার ক্যাম্পে গিয়ে প্রিয়ভাষিণী অবলোকন করেন পাকবাহিনীর অমানুষিক বীভৎসতা। সেখানে অসংখ্য নারীকে তিনি দেখতে পান। তাদের কেউ ছিল অর্ধনগ্ন, কেউ সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অসংলগ্ন আচরণও করছিল। প্রিয়ভাষিণী বুঝতে পারেন হায়েনাদের পাশবিক অত্যাচারের ফসল এটা। প্রিয়ভাষিণী এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন যে ছোটবেলায় মায়ের থেকে কারো নিকট মাথা নত করতে না শেখা প্রিয়ভাষিণী যাকে-তাকে পা জড়িয়ে ধরে বলতে থাকেন, আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে যেতে দাও। তার অবস্থা তখন এতটাই অসহায় ছিল যে পাকবাহিনীর এক আফিসার তাকে দেখে মর্মাহত হয়ে পড়ে। পরে ঐ আর্মি অফিসারের সহায়তায় তিনি সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন।

কিন্তু পালিয়েও কি নিস্তার পেয়েছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী? না, পাননি। পালিয়ে তিনি হায়েনাদের কবল থেকে বাঁচলেও সম্ভ্রম হারানোর যন্ত্রণা নিয়মিত তাড়া করে ফিরছিল ভাষিণীকে। তিনি এতটাই বিষাদগ্রস্ত ছিলেন যে তখন আয়নায় নিজের মুখ দেখতেও ভয় পেতেন।

ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাইরে এসে তিনি যে দৃশ্য অবলোকন করলেন তা ছিল আরো ভয়াবহ। সবাই এমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে যে, সেই চাহনিতে পরিষ্কারভাবে উঁকি দিচ্ছে অচ্ছুত, কুলটাজাতীয় বিশেষণগুলো। পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূলে চলে গিয়েছিল যে নিজের বাড়িও যেন তখন তার নিকট অপরিচিত স্থান। তাদের মাঝেও কেমন যেন অনীহা কাজ করছিল তার প্রতি। সম্ভ্রম হারানোর গ্লানি তাড়া করে বেড়ানো ফেরদৌসী পরিবারের সদস্যদের এমন আচরণে আরো কুঁকড়ে যান।

সবার কাছে এমন পরিত্যক্তা হয়ে যখন মৃতের মতো জীবনযাপন করছিলেন, ঠিক তখন তার কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে, তাকে মানুষের মতো ভালোবাসতে পাশে এসে দাঁড়ান এক মহামানব। তিনি প্রিয়ভাষিণীর দ্বিতীয় স্বামী। নাম আহসান উল্লাহ। ১৯৭২ সালে আহসান উল্লাহর সাথে বিয়ে হয় প্রিয়ভাষিণীর। তিনি পাশে এসে দাঁড়ানোয় প্রিয়ভাষিণী অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও চারপাশের পরিস্থিতি আগের মতোই ঘোলাটে থেকে যায়।

এভাবে নিগৃহীত হয়ে তিনি যখন জীবন ধারণ করছিলেন সেই সময় ব্যবহার অনুপযোগী পরিত্যক্ত জিনিসগুলো দেখে সমাজ পরিত্যক্তা প্রিয়ভাষিণীর ওদের নিজের মতোই পরিত্যক্ত মানুষ মনে হয়। তাই মানুষ ছেড়ে এদের সাথেই ভাব জমাতে শুরু করেন তিনি। পরিত্যক্ত ডালপালাসহ ব্যবহারের অযোগ্য, ফেলে দেওয়া জিনিসপত্রকে তিনি দিতে থাকেন শৈল্পিক রূপ। সেগুলো দিয়ে বানাতে থাকেন ভাস্কর্য। কথায় আছে, দুঃখ থেকে শিল্পের জন্ম, কষ্ট থেকেই শিল্প উঁকি দেয়। প্রিয়ভাষিণীর বেলায়ও যেন তা-ই হয়। আর এভাবেই বীরাঙ্গনা প্রিয়ভাষিণীর ভাস্কর সত্তার আবির্ভাব ঘটে ১৯৮৪ সালে। এস এম সুলতানের সাহায্যেই ১৯৯৪ সালে বেঙ্গলে তার ভাস্কর্যের প্রথম প্রদর্শনী হয়। আর সমাজ সংসারের দেওয়া অপবাদ ও বিগ্রহের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে প্রিয়াভাষিণী হয়ে ওঠেন ভাস্কর প্রিয়ভাষিণী। তার শিল্পে উঠে আসে দ্রোহ, যাপিত জীবনের আনন্দ, বেদনা ও ভালোবাসা। তিনি দেশে-বিদেশে সমাদৃত হতে থাকেন একজন ভাস্কর হিসেবে। তার শিল্পকর্মের একে একে এগারোটি একক প্রদর্শনীসহ বেশ কিছু যৌথ প্রদর্শনী হয়। তিনি পান সম্মানের জায়গা, পান শ্রদ্ধার জায়গা।

আজন্ম দেশপ্রেমিক প্রিয়ভাষিণী যেন এক আজন্ম যোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ নয় মাস হলেও তার যুদ্ধ ছিল যেন আমরণ। অবশেষে দীর্ঘ ৪১ বছর পর ২০১৬ সালে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য প্রিয়ভাষিণীকে দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

Wordbridge School
Link copied!