• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘মানসিক রোগ বড়ই নিষ্ঠুর, যেটার সঙ্গে ক্রমাগত লড়ছি আমিও’


ক্রীড়া ডেস্ক আগস্ট ১, ২০২১, ০৩:১৩ পিএম
‘মানসিক রোগ বড়ই নিষ্ঠুর, যেটার সঙ্গে ক্রমাগত লড়ছি আমিও’

ঢাকা: প্রতিদিনই এই প্রশ্ন আমাদের শুনতে হয় ‘কেমন আছ তুমি?’। কিন্তু আমরা কতবার মন থেকে ‘ভালো আছি’ বলে জবাব দিই? অন্যের পাশাপাশি নিজেকেও কি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, আদৌ ভালো আছি কি না? তোমরা আমার সত্যিটা জানতে চাও? আমি কেমন আছি? এই কোয়ারেন্টিন-জীবন আর মহামারিকাল কীভাবে কাটাচ্ছি? আমি বলব, নিশ্বাস নিচ্ছি।

যখন লড়াই আরও কঠিন
মাসখানেক ধরে আমার মেজাজ অনবরত ভালো আর খারাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই মহামারিকালে জীবনের অন্যতম ভীতিকর সময়টা কাটাচ্ছি। আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ যে আমি আর আমার পরিবার সুস্থ আছি, সচ্ছল আছি, আমাকে তিনবেলার খাবার নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না, অভাব–অনটনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে না। কিন্তু এরপরও ভীষণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হচ্ছে।

২০১৬ সালের রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকের আগে প্রথমবারের মতো আমি আমার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মুখ খুলি। আমি ঠিক নেই, সবার সামনে এটা স্বীকার করা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু সবাইকে সব খুলে বলার পর আমার ওপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা সরে যায়, জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এখন আবার সবার সামনে এসেছি কিছু কথা বলতে, নিজেকে আবার হালকা করতে। আমি চাই লোকে জানুক, যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কষ্ট পাচ্ছে, তারা কেউ একা নয়। বর্তমান সময়ে মানসিক রোগগুলোর সঙ্গে আমাদের আগের চেয়েও অনেক বেশি লড়াই করতে হচ্ছে।

যে লড়াইয়ের ‘ফিনিশ লাইন’ নেই
যারা মানসিক রোগে ভোগে, তারা জানে যে এই রোগ কখনো ছেড়ে যায় না। কখনো রোগ ভালো হয়, কখনো আবার অল্পতেই খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিকার বলে কিছু নেই। এটা এমন এক লড়াই, যার কোনো ‘ফিনিশ লাইন’ থাকে না। রিওর অলিম্পিকের পর অনেকে সাক্ষাৎকার দিয়েছে, আমাকে নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে: ‘মাইকেল ফেলপস হতাশা নিয়ে মুখ খুললেন’, ‘মানসিক রোগের চিকিৎসা নিলেন’, ‘আবার অলিম্পিকে স্বর্ণ জিতলেন’, ‘এরপর সুখে-শান্তিতে-সুস্থভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন’ ইত্যাদি।

                     ফেলপসের জীবনে অর্জিত সোনাগুলো

আহা! এসব যদি সত্যি হতো! এসব যদি এতই সহজ হতো, কত ভালোই না হতো! কিন্তু সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এসব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের অজ্ঞতা আর মূর্খতা আর কিছুই না। যাঁরা কোনোদিন অবসাদ, হতাশা বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগেননি, তাঁরা এর সংগ্রামটা বুঝবেন না।

আমি চিকিৎসা নিয়েছি, ক্যারিয়ারের সফলতম অবস্থানে থাকা অবস্থায় অবসর নিয়েছি। সবার জানামতে এটা দারুণ এক সাফল্যের গল্প হতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমি কোনোদিন সুস্থ হতে পারব না। মানসিক রোগ আমাকে আর কোনোদিন ছেড়ে যাবে না। জীবনকে স্বাভাবিক গতিতে ফেরানোর জন্য আমাকে এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে এবং নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে সব সময় প্রাধান্য দিতে হবে। আর হ্যাঁ, আমি যা বলছি, এ সবই বলা সহজ কিন্তু করা অনেক কঠিন।

যখন পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে যায়
প্রশ্ন করতে পারো, আমি কীভাবে নিজের এই লাগামহীন আবেগকে বশে আনি? কীভাবে সামলে নিই নিজেকে? আমি নিয়মিত দিনে ৯০ মিনিট শরীরচর্চা করি। সকাল পাঁচটা থেকে সাতটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে দিনের শুরুতেই জিমে যাওয়ার চেষ্টা করি। মাঝেমধ্যে যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু নিজেকে রীতিমতো টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাই। নিজের জন্য, নিজের শারীরিক আর মানসিক সুস্থতার জন্য। এক দিন যদি জিমে না যাই, ওই দিন খুব খারাপ অবস্থা হয়। মুহূর্তেই আমার মাথার ভেতর নানা ধরনের নেতিবাচক চিন্তার আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যে বুঝে ওঠার সময় মেলে না। নিজের ভেতর অহেতুক অপরাধবোধ কাজ করে, নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে। খুবই ভীতিকর হয়ে ওঠে অনুভূতিগুলো।

                         পুলে প্রতিযোগিতার সময় ফেলপস

যখন নিয়মিত সাঁতার কাটতাম, পুল ছিল আমার একমাত্র আশ্রয়। নিজের ভেতরের সব অস্থিরতা, চাপ, ক্ষোভ আমি সেখানে গিয়ে অনুপ্রেরণায় বদলে ফেলতাম। কিন্তু এখন মহামারিকালে তো সেই আশ্রয়ও নেই। আমি উপলব্ধি করলাম, সংকটের এই সময়ে পরিবারই হতে পারে আমাদের আশ্রয়। যখন খুব বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাই, তখন সবকিছু থামিয়ে দিয়ে আমি নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলি। আমি চাই না, আমার বাচ্চারা আমাকে এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখুক। 

তাই নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য আমি একটা ঘরে গিয়ে একা সময় কাটাই। নিভৃতের সময়গুলোয় যখন সব অতিষ্ঠ লাগে, তখন সেখান থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন। ওই মুহূর্তে হঠাৎ করে দৌড়ে এসে আমার চার বছর বয়সী সন্তান বুমার যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে, তখন এক নিমেষেই পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে যায়।

তখনই আমি উপলব্ধি করি, নিজেকে ভালো রাখার জন্য নিজেকেই পথ খুঁজে বের করতে হবে। ফোন হাতে তুলে কথা বলতে হবে অথবা অ্যাপ থেকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহায়তা নিতে হবে। আর না হলে খুঁজতে হবে নিজের নিরাপদ আশ্রয়। মোটকথা, সবার আগে নিজেকে সাহায্য করতে হবে, তবেই সবাই এগিয়ে আসবে তোমার সাহায্যে।

আমি আমার ছেলেদের দেখে শিখেছি, কীভাবে হোঁচট খেয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে হয়। ওরা খেলতে গিয়ে হোঁচট খায়, কিছুক্ষণ গলা ছেড়ে কাঁদে, এরপর ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই সব ভুলে গিয়ে আবার ভাইয়েরা মিলে হাসি-দুষ্টুমিতে মিলিয়ে যায়। ওদের এই এগিয়ে যাওয়া, সহিষ্ণুতা আর প্রতি মুহূর্তে বাঁচার উচ্ছলতা আমাকে সাহস দেয়। আমাদেরও তো এমন সহজভাবেই জীবনে এগিয়ে চলা উচিত।

নিজের ভেতরের অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তার পেছনে লুকানোর কিছু নেই। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সহজ জীবনযাপনই পারে কঠিন লড়াইগুলোকে সহজ করে দিতে। কথাগুলো মনে রেখো; যখন এর পরেরবার কেউ তোমাকে সহজ প্রশ্নটা করবে, ‘কেমন আছ তুমি?’। সূত্র: প্রথম আলো

সোনালীনিউজ/এআর

Wordbridge School
Link copied!