• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’

পদ্মাপাড়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস


সেলিম আহমেদ ডিসেম্বর ১২, ২০২০, ১২:০৬ পিএম
পদ্মাপাড়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা : প্রমত্তা প্রদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’। সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে নানা বাধা ও আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে জোড়া লেগেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের সেই স্বপ্ন। অপেক্ষা শুধু কবে যান চলাচল শুরু হবে। বহুল প্রতীক্ষিত এই সাফল্যকে একবার ছুঁয়ে দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসুক মানুষ ভিড় করছেন পদ্মার উভয় পাড়ে। গতকাল ছিল ছুটির দিন।

শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) ছুটির দিনেও সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে পুরো পদ্মাপাড়। ভোরের কুয়াশার মধ্যে সূর্যের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের সংখ্যা। বিকেলে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পদ্মাপাড়। তবে নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে সেনাসদস্যরা প্রকল্প এলাকার ভেতর কাউকে প্রবেশ করতে দেননি। তবে দর্শনার্থীরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা-ট্রলার ও স্পিডবোটে করে ছুটে গেছেন সেতুর একবারে কাছাকাছি। প্রাণভরে দেখেছেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

কাক্সিক্ষত সেই মুহূর্তকে সাক্ষী করে রাখতে তুলেছেন সেলফি, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি। যেন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে পদ্মাপাড়ে। স্বপ্নের এই সেতুকে কাছ থেকে দেখতে সিলেট থেকে ছুটে এসেছেন এমসি কলেজের শিক্ষার্থী আজহার উদ্দিন শিমুল। মাওয়া ঘাট থেকে স্পিডবোটে করে ছুটে গেছেন ব্রিজের কাছেই।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের ১৬ কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। তাই সেতুটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হওয়ার পরপরই ছুটে এসেছি একনজর দেখার জন্য।

ঢাকা থেকে ১০ বন্ধুকে নিয়ে গেছে একটি বেসরকারি ফার্মের কর্মকর্তা জামিল আহমদ। তিনি বলেন, আমরা ভাবতেও পারছি না নিজেদের টাকায় এত বড় অবকাঠামো বানাতে পারব। বিজয়ের মাসে এমন বিজয় আমাদের উচ্ছ¡সিত ও আনন্দিত করেছে। বৃহস্পতিবার সর্বশেষ স্প্যান বসানোর দিন আসতে পারিনি, তাই ইতিহাসের সাক্ষী হতে আজ (গতকাল শুক্রবার) এসেছি। এখন শুধুই অপেক্ষা সেতু পারাপার হওয়ার।

শেষ স্প্যান বসানোকে কেন্দ্র করে গত বৃহস্পতিবার দিনভর পদ্মাপাড়ের জাজিরার নাওডোবা থেকে মাওয়া প্রান্তর পর্যন্ত পদ্মা নদী ছিল নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে। সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল সংরিক্ষত। গণমাধ্যমকর্মী ও বিশিষ্টজন ছাড়া মাঝ পদ্মায় ব্রিজ এলাকায় কাউকে ভিড়তে দেয়া হয়নি। স্প্যান বসানোকালীন সময়ে ন্যূনতম ৭০০ মিটারের ভেতরের কাউকে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। এর পরও নানা প্রতিক‚লতা ডিঙিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হতে এসেছিলেন অনেকে। তবে বৃহস্পতিবারের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে না পারলেও গতকাল ইতিহাসের সাক্ষী হতে ভিড় করেন হাজার হাজার মানুষ।

পরিবারের সবাইকে নিয়ে স্পিডবোটে করে পদ্মাকে দেখতে এসেছেন মুন্সীগঞ্জের রায়হান আহমদ। তিনি বলেন, আমরা অনেক আনন্দিত, আমরা অনেক খুশি। এই সেতুর ফলে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের মেলবন্ধন ঘটবে। যোগাযোগে আমাদের যে প্রতিবন্ধকতা, সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করার আরো একটি চ্যালেঞ্জ পূরণ হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বেই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হলো। আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ।

একই স্পিডবোটে ছিলেন গৃহিণী হোছনে আরা বেগম। তিনি বলেন, আমরা ব্রিজ দেখতে এসেছি। দেখে অনেক ভালো লেগেছে। কাজ দ্রুত শেষ হলে আমরা ব্রিজ দিয়েই চলাচল করতে পারব। তখন এই এলাকায় কাজ-কর্মও বাড়বে। পাশের আরেক নৌকার যাত্রী আনিছুর রহমান নামের এক তরুণ বলেন, মনে হচ্ছে দ্রæতই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। পদ্মাপাড়ের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাকে জানাই লাল সালাম।

মাওয়া ঘাটে কথা হয় চা দোকানি ষাটোর্ধ্ব হাসমতের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে একটি সেতু হবে- তা আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মাপজোখ, পিলারের পর স্প্যানের কাজ শেষ হলো। হয়ত দ্রুতই শেষ হবে অন্য কাজগুলোও।

এদিকে পদ্মা সেতুর পুরো অবকাঠামো দৃশ্যমান হওয়ায় খুশির জোয়ারে ভাসছে পদ্মা তীরবর্তী এলাকার মানুষ। সেতুটি অবয়ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। দূরত্ব কমে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের সংযোগ স্থাপিত হওয়ায় দুই অঞ্চলের অর্থনীতিতেই ঘটবে উল্লম্ফন। সেই সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিও লাভবান হবে। তাইতো বিভিন্ন এলকায় আতশবাজি ও ফানুস উড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ মিছিল করা হয়েছে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের পাশাপাশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের জীবিকায়ও। এবার অপেক্ষা শুধু যানচলাচল শুরুর।

মওয়া ঘাটে কথা হয় পারভেজ মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, পদ্মা ব্রিজ হলে আমাদের কী উপকার হবে তা বলে বোঝাতে পারব না। আগে নদী পার হওয়ার জন্য শুধুমাত্র ফেরির জন্যই অপেক্ষা করতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ব্রিজ চালু হলে আমাদের সেই অপেক্ষা করতে হবে না। সহজেই এপার থেকে ওপারে যেতে পারব।

বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি নিজামউদ্দিন বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির গতি যে কতটা পাল্টে দেবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। এরইমধ্যে বরিশাল অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ। তারা এখানে শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে।’

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতু হলো এই পদ্মা সেতু। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও স্বপ্নের সেতু এটি। তিনি যে সাহস নিয়ে এ সেতুর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। দেশের নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেটা প্রমাণ হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রায় সাত বছর কাজ এগোয়নি। স্থান নির্ধারণের পর অর্থায়ন জটিলতায় যায় আরো পাঁচ বছর। কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেতুর অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। ঠিক পাঁচ বছর পর সব স্প্যান বসানোর মাধ্যমে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান।’

প্রকল্প পরিচালক জানান, পদ্মা পাড়ের মানুষ মনে করেন, সেতু চালু হলে কৃষিপণ্য পরিবহনে সুবিধা হবে। কৃষিপণে?্যর সঠিক দাম পাওয়া যাবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পদ্মা সেতু তাদের জন্য আশীর্বাদ।

স্বপ্নের পদ্মা সেতুর আরো যা বাকি: দৃশ্যমান ৬ হাজার ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতুটির বাকি কাজ শেষ হতে লাগবে প্রায় আরো এক বছর। প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আবদুল কাদের জানিয়েছেন, ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর ২৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে ১২৮৫টি এবং ২৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাবের মধ্যে ১৯৩০টি স্থাপন করা হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরা ভায়াডাক্টে ৪৮৪টি সুপার-টি গার্ডারের মধ্যে ৩১০টি স্থাপন করা হয়েছে। বাকি রোডওয়ে স্ল্যাব, রেলওয়ে স্ল্যাব ও সুপার-টি গার্ডার বসাতে প্রায় আট মাস সময় লাগবে। এরপরে স্ল্যাবের ওপর হবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ।

এছাড়া ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজও বাকি। তিনি আরো জানান, ভাঙনের কারণে পদ্মা সেতুর ১২৬টি রোডওয়ে স্ল্যাব ও ১৯২টি রেলওয়ে স্ল্যাব নদীতে তলিয়ে যায়। সেগুলো নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। রেলওয়ে গার্ডার লুক্সেমবার্গ থেকে আনা হবে। আগামী ফেব্রয়ারি মাস নাগাদ সেগুলো কনস্ট্রাকশন সাইটে চলে আসার কথা। এসব কাজ ছাড়াও বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিযোগাযোগ লাইন স্থাপনের কাজ বাকি আছে।

সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (নদী শাসন) শরফুল ইসলাম সরকার জানান, সেতুর দক্ষিণপ্রান্তে মোট ১২ কিলোমিটার নদী শাসন কাজ হবে। এর মধ্যে ৮ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এলাকায় তিন কিলোমিটার নদী শাসন কাজ বাকি আছে এবং উজানে আরো এক কিলোমিটার কাজ চলমান আছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের লক্ষ্য আগামী বর্ষার আগে নদী শাসনের প্রধান কাজ, যেমন- ড্রেজিং, বালুর বস্তা ফেলা, সিসি বøক ফেলা ইত্যাদি কাজ শেষ করা। যদি বর্ষার আগে এসব কাজ শেষ করা যায় তাহলে বর্ষা মৌসুমে পাথর ফেলা (ডাম্পিং) যাবে।

পদ্মা সেতু পারাপারে টোল দিতে হবে কত: সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে এই পদ্মা সেতু। নির্মাণ ব্যয় যা-ই হোক, সেই অর্থ টোল আদায়ের মাধ্যমে তুলবে সরকার। সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি পারাপারে নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল আদায় করা হবে। সেই টোলের হার কত হবে- তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। টোলের একটি প্রাথমিক হার নির্ধারণ করে প্রস্তাবনা দিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)।

সেতু বিভাগের টোল প্রস্তাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতু দিয়ে পারাপার হতে বাসে থেকে টোল আদায় করা হতে পারে ২ হাজার ৩৭০ টাকা। ছোট ট্রাকের জন্য ১ হাজার ৬২০ টাকা, মাঝারি ট্রাকের জন্য ২ হাজার ১০০ এবং বড় ট্রাক থেকে টোল ২ হাজার ৭৭৫ টাকা আদায় করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর প্রাথমিকভাবে ১৫ বছরের জন্য এই টোল আদায় করা হবে। প্রতি ১৫ বছর পরপর টোলের হার ১০ শতাংশ করে বাড়ানো হবে।

বর্তমানে দিনে ফেরি দিয়ে পদ্মা পার হতে হলে একটি বাসকে টোল দিতে হয় ১৪০০ টাকা। যদি বাসটিতে যাত্রী থাকে, তাহলে আরো ৪৫০ টাকা দিতে হয়। আর যদি বাসটি রাতে পাড়ি দেয় তাহলে আরো ৪৭০ টাকা দিতে হয়। সে হিসাবে, একটি যাত্রীবাহী বাসকে দিনের বেলা ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিলে টোল দিতে হয় মোট ১৮৫০ টাকা এবং রাতে দিতে হয় ২৩২০ টাকা। এ ছাড়া ট্রাক থেকে টোল আদায় করা হয় ১৮৫০ টাকা। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণের পর প্রতি টনে আরো ১৬০ টাকা করে টোল দিতে হয় ট্রাককে। এছাড়াও ফেরিতে প্রাইভেটকারের টোল নেয়া হয় ৫০০ টাকা, মাইক্রোবাস থেকে ৮৫০ এবং মোটরসাইকেল থেকে ৭০ টাকা টোল আদায় করা হয়। মানবকণ্ঠ।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!