• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেলের ভুলে ৪০০ কোটি টাকা গচ্ছা


নিউজ ডেস্ক জুলাই ২৯, ২০২১, ১০:৫৩ এএম
রেলের ভুলে ৪০০ কোটি টাকা গচ্ছা

ফাইল ছবি

ঢাকা : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুর প্রায় ৬ বছর পর পরিকল্পনায় ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। দীর্ঘ সময়ে কাজ হয়েছে ৭৫ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে আড়াইশ কোটি টাকার বেশি। এ অবস্থায় একই জায়গায় নতুন একটি প্রকল্প নিতে হচ্ছে। এতে ব্যয় হবে আরও চারশ কোটি টাকার বেশি। এখন যে প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে প্রথম থেকেই এর কাজ করা সম্ভব ছিল। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত বরাদ্দ থেকে প্রায় চারশ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হতো।

কিন্তু রেলওয়ের ভুলের কারণে এ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ৩৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে চলমান মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজ করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। শুরুতে পরিকল্পনা গ্রহণেই ছিল ভুল। সে সময় বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনটি যদি ডাবলগেজ আলাদা দুটি লাইন করা হতো তবে কোনো সমস্যা ছিল না।

কিন্তু রেলের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ডাবলগেজ লাইন করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পটির কাজই ৭৫ ভাগ শেষ হয়েছে। এটি ২০১৭ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেখানেও নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ চলছে। ফলে ২০২১ সালেও কাজটি শেষ হয়নি। এ পর্যায়ে এসে পরিকল্পনায় ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতুতে ট্রেন চালু হলে চাপ বাড়বে। কাজেই ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত নতুন লাইনের পাশে আরও একটি লাইন বসাতে হবে।

মন্ত্রণালয় সংশোধিত হিসাবে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৭৮২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ রেলপথটি নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে ৪০৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বা ১০৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, জাপান এ প্রকল্পে আর অর্থায়ন করবে না। ব্যয়বৃদ্ধি যত হয় সবই বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে যাবে।

এ বিষয়ে রোববার সন্ধ্যায় রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটির ইতিহাস রয়েছে। এটি এখন সবচেয়ে অবহেলিত। আমরা আরডিপিপি পেয়েছি যত দ্রুত সম্ভব তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। চলমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর প্রকল্পটি আগের নেওয়া প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলে সমস্যার সৃষ্টি হতো না।

এখন চলমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতে না পারলে চলমান ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ শেষে এর সুফলও আসবে না। দুই লাইনের মধ্যে অসম উঁচু-নিচুসহ নানা সমস্যা রয়েছে। প্রকল্প গ্রহণের সময়ই পরিকল্পনায় ভুল ছিল। যে ভুলের মাসুল এখন দিতে হচ্ছে। শুরুতেই যদি ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হতো তাহলে নতুন করে এত টাকা লাগত না। জাপানের অর্থায়নেই প্রকল্পটি সমাপ্ত হতো।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ চলমান রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এর আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া এ পথ ঘেঁষেই ২০১৫ সালে একটি ডুয়েলগেজ লাইন প্রকল্প নির্র্মাণ শুরু হয়। জাপানের অর্থায়নসহ প্রায় ৩৭৯ কোটি টাকায় এ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। ভুল পরিকল্পনা চিহ্নিত হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এতে জাপান আর অর্থায়ন করছে না বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ভুল আর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় এখন আরও প্রায় ৪শ কোটি টাকা অতিরিক্ত লাগছে।

এক সময় খুবই গুরুত্বপূর্র্ণ ছিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটি। চালু হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। কিন্তু ১৯৮০ সালের পর থেকে এ পথটির গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৯৯০ সালের পর রেলের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় স্থান পায় গুরুত্বপূর্ণ পথটি। আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া জরাজীর্ণ এ পথ দিয়ে লকডাউনের আগে প্রতিদিন ২৮টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলে এ পথে। উনিশ থেকে কুড়ি হলেই লাইনচ্যুতসহ নানা সমস্যায় পড়ে ট্রেনগুলো।

রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী এ প্রসঙ্গে বলেন, ২০১২ সালে এ পথে নতুন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ওই সময় সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তা চলমান লাইনের সংস্কার ছাড়া শুধু নতুন করে একটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের পক্ষে নানা যুক্তি দেন। তারা জানত, চলমানটি বাদ রেখে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে পরে নতুন করে আরেকটা প্রকল্প নেওয়া যাবে। এতে তাদের পকেট ভারি হবে বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এদিকে অপর এক কর্মকর্তা জানান, এ প্রকল্পটি নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। ২০১২ সালে প্রকল্পটির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে সময় একইসঙ্গে এ পথে ডুয়েলগেজের দুটি লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে তা গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্টরা। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন কয়েক বছর আগেই বিদ্যমান ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মিটারগেজ রেলপথটি সংস্কার করা হয়েছে। এমন যুক্তির পর শুধু নতুন একটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্পটি চূড়ান্ত করা হয়।

এদিকে বর্তমানে নির্মিত ডুয়েলগেজের চেয়ে প্রায় তিন ফুট নিচুতে রয়েছে চলমান মিটারগেজ লাইনটি। দুই লাইনের মধ্যে উঁচু-নিচু থাকায় ট্রেন চলাচলে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। ভারি বৃষ্টি হলে চলমান লাইনটিতে পানি জমছে। অন্যদিকে দুটি লাইনের মাঝে লেভেলক্রসিং সমান্তরাল না হওয়ায় সড়কযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।

খোদ রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান প্রকল্পের সঙ্গে ২০১৫ সালে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হলে ৬ বছর পর এমন ভুল ধরা পড়ত না। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেল লাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্পটি অনুমোদন করে একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি)। সে সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৩৭৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপানের অনুদান রয়েছে ২৪৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বাকি ১২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা সরকারের।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সেলিম রওফ জানান, চলমান ডুয়েলগেজ প্রকল্প নির্মাণ কাজ প্রায় ৭৫ শতাংশে এগিয়েছে। গত প্রায় ১ বছর আগ থেকেই চলমান মিটারগেজ লাইনটি নিয়ে নানা সমস্যার কথা উঠে আসছে। সর্বশেষ আমরা একটি সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (আরডিপিপি) প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। এটি মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। আমরা প্রাথমিকভাবে সমীক্ষা শেষে প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। জমা দেওয়া এ প্রকল্প যত দ্রুত পাশ হবে- তত তাড়াতাড়ি এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যাবে।

রেলওয়ের জায়গা অবৈধ দখল, জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে চলমান প্রকল্পটি তিন দফা বাড়িয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। বর্তমানে চলমান মিটারগেজ লাইনকে রূপান্তর করে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ হাতে নেওয়ায় চলমান ডুয়েলগেজ লাইন নির্র্মাণে মেয়াদ আরও বাড়তে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ চলমান রেলপথ দ্রুত সময়ের মধ্যে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করতে না পারলে চলমান ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণেও পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে এ দুটি লাইনের পশ্চিম পাশ দিয়ে ঢাকা-যশোর ডুয়েলগেজ লাইনের কাজও ২০২২ সালের দিকে শুরু হবে। চলমান ডুয়েলগেজ লাইন প্রকল্প ও চলমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ একইসঙ্গে শুরু করতে না পারলে পুরো লাইনেই নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হবে। সূত্র: যুগান্তর।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!