• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মের ভোগান্তি জন্মনিবন্ধনে


নিউজ ডেস্ক নভেম্বর ১৬, ২০২১, ০৯:৩৩ এএম
জন্মের ভোগান্তি জন্মনিবন্ধনে

ঢাকা : সুনামগঞ্জ শহরের জামতলা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বাবুল মিয়া। তার ৬ সন্তান। ছোট দুই ছেলের জন্য জন্মনিবন্ধন করতে মাস দেড়েক আগে সুনামগঞ্জ পৌরসভায় যান তিনি। পৌর কর্মকর্তারা জানান, সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন অবশ্যই থাকতে হবে। এরপর বাবুল মিয়া সুনামগঞ্জ পৌরসভায় নিজের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। গত ১১ অক্টোবর ফি জমা দেন তিনি। অন্তত ৫ দিন পৌরসভার সংশ্লিষ্ট শাখায় যান। কিন্তু জন্মনিবন্ধন পাননি। বাবুল মিয়ার মতো সারাদেশেই সাধারণ মানুষ জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করার শর্তে জটিলতা রয়েছে। রয়েছে সনদ প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা। 

সরকারি ফির বাইরেও নেওয়া হচ্ছে অর্থ। পাসর্পোট তৈরি, বিয়ে ও জমি রেজিস্ট্রেশন, শিশুদের করোনার টিকা এবং স্কুলে ভর্তিসহ ১৭টি সেবার ক্ষেত্রে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ‘বাধ্যতামূলক’ ও জরুরি এই সনদ পেতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের জনবল সংকট, ইন্টারনেটের ধীরগতি ও কেন্দ্রীয় সার্ভারে নানা জটিলতার কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা। সম্প্রতি দেশে ১২ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু হলে জন্মনিবন্ধনের সনদ উত্তোলনের হার বেড়ে যায়। কিন্তু এই সনদ সংগ্রহ করতে গিয়ে অভিভাবকরা ঘাটে ঘাটে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকাও। আবার অনেকের জন্মসনদ সংশোধন করতে হচ্ছে। সেখানে ভোগান্তি আরও বেশি। জন্মনিবন্ধন উত্তোলন ও সংশোধনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দালালচক্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, জনবল সংকট, অদক্ষ জনবল, দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, ত্রুটিপূর্ণ প্রযুক্তির ব্যবহার, ইন্টারনেটের ধীরগতি, কেন্দ্রীয় সার্ভারে ত্রুটি, সেবাদানকারীর দুর্ববহার, তথ্য প্রদানে অনীহা এবং নাগরিকদের সচেতনতার অভাবে সারাদেশের ‘জন্মনিবন্ধন সনদ’ কার্যক্রম দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দুর্ভোগ লাগবে সরকারের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম সহজ এবং সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বিভাগীয়, সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ইউনিয়ন জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। তাদের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এসব টাস্কফোর্স ঠিকমতো কাজ করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরকারের বক্তব্য জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন বিষয়ে আমরা জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা যেন জনসাধারণকে জন্মনিবন্ধনে উদ্বুদ্ধ করে তার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘জন্মনিবন্ধনে প্রকৃতপক্ষে কোনো ভোগান্তি নেই। তবে কিছু কিছু অসুবিধা আছে। আমরা অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে এগোচ্ছি।’

মুস্তাকীম বিল্লাহ বলেন, ‘মানুষ সারাবছর জন্মনিবন্ধন করে না। নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এসে সবাই একসঙ্গে নিবন্ধন করতে চায়। ফলে এক সঙ্গে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে সার্ভার অনেক সময় বেশি লোড হয়ে যায়। একটু সমস্যা তৈরি হয়।’ শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যেই জন্মনিবন্ধন করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

জন্মনিবন্ধন সংশোধনে ভোগান্তির বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, ‘সংশোধনে প্রকৃতপক্ষে কোনো ভোগান্তিই নেই। অনলাইনে ঘরে বসে সহজেই সংশোধন করা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ জন্মনিবন্ধনের বিষয়ে এতদিন সচেতন ছিল না। এখন সচেতন হচ্ছে। কারণ ১৬টি সেবা পেতে বাধ্যতামূলকভাবে জন্মসনদ লাগে।’

জন্মনিবন্ধনে নতুন করে করতে কিংবা সংশোধনে কয়েকশ গুণ বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ রকম হলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেন। আমরা ব্যবস্থা নেব। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে খুবই সামান্য পরিমাণে ফি দিতে হয়। এখন যদি দালালচক্র অতিরিক্ত টাকা-পয়সা নেয়, সেটি আমাদের জানান।’

রেজিস্ট্রার জেনারেল আরও বলেন, ‘আমাদের টেকনিক্যাল কাজের লোক মাত্র দুজন। তাদের মধ্যে একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। এ জন্য টেকিনিক্যাল সাপোর্ট তুলনামূলকভাবে কম। আমরা জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘অনেকের নামে একাধিক জন্মনিবন্ধন রয়েছে। আমরা সেসব নিবন্ধন ব্লক (বন্ধ) করে দেব।’

১৬ সেবায় বাধ্যতামূলক

পাসপোর্ট তৈরি, বিয়ে নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার তালিকা তৈরি, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক হিসাব খোলা, আমদানি ও রপ্তানি লাইসেন্স, গ্যাস, পানি, টেলিফোন এবং বিদ্যুৎ সংযোগের অনুমতি, করদাতা শনাক্তকরণের নম্বর, ঠিকাদারি বা চুক্তির লাইসেন্স, ভবন নকশার অনুমোদন, ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্তি এবং মোটরযানের নিবন্ধন পেতে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক।

সারাদেশের হাল

সারাদেশেই জন্মনিবন্ধন তুলতে গিয়ে মানুষকে নাজেহাল হতে হচ্ছে।

বরিশাল : চরম ভোগান্তির অভিযোগ পাওয়া গেছে বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) জন্মনিবন্ধন শাখার বিরুদ্ধে। ভোগান্তির কারণে অনেকেই জন্মসনদ নিতে যাচ্ছেন না। সনদ পেতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি শর্ত। এসব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অনেকেরই হাঁসফাঁস অবস্থা। যাদের জন্ম ২০০১ সালের পর তাদের জন্মনিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্ম সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকে।

বিসিসির জন্মনিবন্ধন শাখার চারটি কম্পিউটারের মধ্যে ২টি প্রায় সময়ই বিকল থাকে। এতে কাজের গতি কমে যায়। আটকা পড়ে হাজারো আবেদন। দুই সপ্তাহ আগে ফরম জমা দিয়েও সনদ হাতে না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকে।

স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে আসা সালমা বেগম নামের এক নারী জানান, স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই জন্মনিবন্ধন আছে। তবে একজনের ইংরেজিতে, আরেক জনেরটা বাংলা। এ কারণে তারা আবেদনই করতে পারছেন না। সন্তানেরটাও হচ্ছে না।

সিটি করপোরেশনের জন্মনিবন্ধনের আবেদনপত্র জমা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা কর্মী ইরানী বেগম বলেন, ‘মা-বাবার নিবন্ধন বাংলায় হলে সন্তানও বাংলায় জন্মনিবন্ধন সনদ পাবে। আর মা-বাবার সনদ ইংরেজিতে হলে সন্তানেরটাও ইংরেজি হবে। আর মা-বাবারটা আলাদা হলে তারা আবেদনই করতে পারবেন না। দুজনেরটা এক ভাষায় করে নিতে হবে। এ ধরনের সমস্যা অনেক হচ্ছে।’

চাঁদপুর : সনদ পেতে জমা দিতে হচ্ছে একগুচ্ছ কাগজ। তাও আবার হাতে পেতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ দিন কিংবা কয়েক মাস। আবার অনেকে মাসের পর মাস ঘুরেও পাচ্ছেন না সনদ। কিছু কিছু গ্রাহকের অভিযোগ, দালালদের হাতে অতিরিক্ত টাকা দিলেই দ্রুত সনদ মেলে। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি, সার্ভার সমস্যার কারণেই সনদ দিতে দেরি হয়।

চাঁদপুর পৌরসভা কার্যালয় জানায়, জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে অনলাইন আবেদনপত্রের সাথে মা-বাবার জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা বয়স প্রমাণের সনদপত্র, স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্র বা হোল্ডিং নাম্বারের কাগজ এবং শিশুদের ক্ষেত্রে শিশুকার্ড (ইপিআই কার্ড) সংযুক্ত করে জমা দিতে হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ নতুন জন্মনিবন্ধন সনদে ১০০ টাকা, সংশোধনীতে ২০০ টাকা ও প্রতিলিপির ক্ষেত্রে ১০০ টাকা ফি (রিসিটের মাধ্যমে) নেয়। তবে অনেকের কাছ থেকে ১০০০ টাকা নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইল পৌরসভায় জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে এসে অনেকেই চরম ভোগান্তির অভিযোগ তুলেছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, দক্ষ জনবলের অভাবেই এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শহরের কাগমারার বাসিন্দা ইকবাল বলেন, ‘নতুন জন্মনিবন্ধন করতে এসেছি। হাতে কাগজ নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে করতে পারলাম না। অফিস বলছে সার্ভার বন্ধ। এ রকম নানা অজুহাত তারা প্রতিনিয়তই দিচ্ছে।’ টাঙ্গাইল পৌরসভার সচিব শাহনেওয়াজ পারভীন বলেন, ‘সফটওয়্যার বেশ সমস্যা করছে।’

শরীয়তপুর : ইউনিয়ন ও পৌরসভা থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ তুলতে গিয়ে নানা ভোগান্তির অভিযোগ তুলেছেন সেবাপ্রার্থীরা। তারা জানান, জন্মসনদ পেতে তিন-চার মাস পর্যন্ত লেগে যায়। সনদ পাওয়ার পর দেখা যায় তাতে অনেক ভুল। সেই ভুল সংশোধন করতে গেলে নতুন করে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক আবেদা আফসারী বলেন, ‘৪৫ দিনের মধ্যেই জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করার বিধান। কিন্তু মানুষ তা করে না। সময়মতো নিবন্ধন না করার কারণেই এই সমস্যা বাড়ছে।’

রাঙামাটি : ১০ উপজেলার ৫০টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ২টি পৌরসভায় এ কার্যক্রমে মানুষ এখন নাকাল। উপজেলা ও পৌরসভার সেবা প্রদানে যে ফি, তার চেয়েও দুই-তিনগুণ বেশি অর্থ দিতে হচ্ছে মানুষকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ইউপি সচিব ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের চৌকিদাররাই নিয়ন্ত্রণ করছেন এই সেবা।

পিরোজপুর : ঝামেলার কারণে অনেকেই জন্মসনদ নিতে ইউনিয়ন পরিষদে যাচ্ছেন না। বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সনদ পেতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি শর্ত। বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারি ট্যাক্সের রসিদের হালনাগাদ সনদ, আবেদনকারী অভিভাবকের মোবাইল নম্বর, ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি, আবেদনের সঙ্গে কাগজপত্র সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য- নারী সদস্যদের স্বাক্ষরসহ সিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

বগুড়া : শিবগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মারিয়া কিপতিয়া করোনা ভাইরাসের টিকার নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। জন্মসনদে তার বাবার নাম ভুল রয়েছে। এ জন্য নিবন্ধন হচ্ছে না। পৌরসভায় গিয়ে সংশোধন কার্যক্রম চালাতেও পারছেন না। কারণ তিন দিন ধরে জন্মনিবন্ধনের সার্ভার ডাউন হয়ে আছে। জন্মনিবন্ধনের ছোটখাটো এ রকম অসংখ্য সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন ২৫-৩০ জন মানুষ এলেও সার্ভার ডাউনের কারণে তারা ফিরে যাচ্ছেন। সূত্র: আমাদের সময়।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!