• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসিআরে আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৩, ২০২২, ০২:৪৫ পিএম
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসিআরে আসছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

ঢাকা: বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাৎসরিক গোপন প্রতিবেদন (অ্যানুয়াল কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট বা এসিআর) পদ্ধতি নিয়ে অনেক অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।এর প্রেক্ষিতে এসিআরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার।

বর্তমানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে এসিআরের আকাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন পেতে অধস্তনদের চিন্তার অন্ত থাকে না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা ‘বস’ যা বলেন এসিআরে তাই চূড়ান্ত। গোপনীয় প্রতিবেদনে ‘বস’ কী মূল্যায়ন করলেন জানারও উপায় নেই।এর ঠিক উলটো বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসিআরের বদলে অ্যানুয়েল পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল রিপোর্ট (এপিএআর বা বাৎসরিক কর্ম মূল্যায়ন প্রতিবেদন) প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণা নিয়ে তৈরি হতে যাওয়া এপিএআরের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।

গ্রেড-৯ থেকে গ্রেড-২ পর্র্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা এর আওতায় আসবেন। শিগগিরই এ সংক্রান্ত প্রস্তাব প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে পাঠাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এবিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের লক্ষ্য সঠিক জায়গায় সঠিক অফিসারকে পদায়ন করা। এর জন্য প্রত্যেক অফিসারের কর্মভিত্তিক প্রোফাইল থাকা প্রয়োজন। এটা না থাকায় বর্তমানে শুনে শুনে অফিসার বাছাই করতে হয়। কিন্তু এপিএআর চালু হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারের প্রোফাইলের ভিত্তিতে বাছাই করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এটা অনেক বড় কাজ হচ্ছে। যা সরকারি কাজের সেবায় বিশাল পরিবর্তন আনবে বলে আমার বিশ্বাস।

বর্তমান এসিআরের পুরোটাই ব্যক্তিগত ও পেশাগত বৈশিষ্ট্যের মূল্যায়ন হয়। যেমন-ব্যক্তিত্ব, সময়ানুবর্তিতা, সততার ইত্যাদির মতো ২৫টি মানদণ্ড আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বছরব্যাপী কী কাজ করলেন, করলে ঠিকমতো করেছেন কিনা সেটার মূল্যায়ন নেই। অর্থাৎ বিদ্যমান এসিআরের ১০০ নম্বরের পুরোটাই বৈশিষ্ট্যনির্ভর। কিন্তু এপিএআরে কর্মচারীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের নম্বর থাকে ৪০। আর বছরব্যাপী কাজের মূল্যায়নের নাম্বার হবে ৬০। বর্তমানে এসিআরের সময়কাল জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বের। এপিআরএতে সময়কাল হবে অর্থবছরকেন্দ্রিক অর্থাৎ জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত। কারণ এপিএআরকে অ্যানুয়েল পারফরম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্টের (এপিএ) সঙ্গে যুক্ত করে মূল্যায়ন করা হবে। প্রত্যেক কর্মচারীর নিজস্ব অর্জন ও প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন মিলিয়ে এপিএআর নির্ধারণ হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ধারার বর্তমান এসিআর পদ্ধতিতে কিছু বিষয় যোগ করা হলেও মৌলিক পরিবর্তন ছিল না। এবার সেই জায়গাতে হাত দেওয়া হয়েছে।

এপিএআর-খসড়া প্রস্তুতের সঙ্গে যুক্ত একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এটা চালু হলে এসিআর ভীতি আর থাকবে না। কাজের ভিত্তিতে সরকারি চাকুরেরা নিজেরাই নিজেদের মূল্যায়ন করতে পারবেন। এতে করে দেশব্যাপী সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহি বাড়বে।

খসড়া অনুযায়ী, এপিএআর হবে সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীর জন্য একটি করে অনলাইন অ্যাকাউন্ট হবে। এতে চাকরিতে ঢোকার প্রথম দিন থেকে শেষ দিনের প্রয়োজনীয় তথ্য থাকবে। অ্যাকাউন্টে কর্মচারীরর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির আপডেট থাকবে, কে কতবার বিদেশ সফরে গেছেন, কোন কোন দেশে গেছেন এসব তথ্য থাকবে। পরবর্তী সময়ে ওইসব দেশ সম্পর্কিত কাজের জন্য সহজেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খুঁজে পাবে সরকার। একইসঙ্গে তথ্য গোপন ও অন্যদের বঞ্চিত করে বারবার বিদেশ সফরে যেতে পারবে না কেউ।

প্রস্তাবিত খসড়া অনুযায়ী, একজন চাকুরে প্রতি বছর কী কী কাজ করবেন তার একটি টার্গেট ঠিক করবেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগদানের ১৫ দিনের মধ্যে বা ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এ পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। প্রত্যেককে অন্তত ১২টি কাজের চুক্তি করতে হবে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে। প্রতিটি কাজের নাম্বার হবে ২ থেকে ৮। বড় কাজের মান অনুযায়ী নাম্বার কম-বেশি হবে। প্রত্যেকটি কাজের লক্ষ্যমাত্রা, প্রমাণক থাকতে হবে। প্রতিজন তার সক্ষমতার ৬০ ভাগ কাজ করার চুক্তি বছরের প্রথমে করবেন। বাকি ৪০ ভাগ থাকবে কমন কিছু কাজের জন্য। একইসঙ্গে চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর নতুন কাজ আসলে যাতে সংশ্লিষ্টদের কাজে বোঝা বেশি না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ বলে জানা গেছে। বছর শেষে চুক্তিবদ্ধ কাজের সর্বশেষ তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারী তা অ্যাকাউন্টে এন্ট্রি করবেন। উপস্থাপিত প্রমাণপত্র অনুযায়ী তা যাছাই করবেন নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারা।

বর্তমানে কোনো দপ্তরের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জনবল আছে। আবার কোনো দপ্তরে প্রয়োজনে চেয়েও জনবল পাওয়া যায় না। এপিএআর চালু হলে সব দপ্তর সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তথ্য পাবে সরকার। কোথায় জনবল বেশি, কোথায় কম তা ধরা পড়বে। তাই সহজে এ বিষয়ে সমন্বয় করা যাবে। একইসঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ হয় সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এপিএআরের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা থাকবে। এর বাইরে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তর-সংস্থাগুলো তাদের কর্মচারীদের জন্য আলাদা এপিএআর অধিশাখায় এ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা রাখবে। নতুন পদ্ধতিতে কর্মচারীর, পিতা, মাতা, জন্ম তারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্ম নিবন্ধন নাম্বার, পদবি, গ্রেড, বেতন, কর্মস্থল, ক্যাডারের নাম, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের নাম ও মোবাইল, ইমেইল নাম্বার থাকবে। কারও নিজ পরিবারের কেউ না থাকলে নিকটাত্মীয়র তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে, এছাড়া চাকরিতে যোগদানের তারিখসহ খুঁটিনাটি সব তথ্য থাকবে এপিএআরে।

এপিএআর পদ্ধতিতে সরাসরি নাম্বার না দিয়ে গ্রেডিং পদ্ধতি প্রবর্তন হচ্ছে। এতে ৯৬-১০০ এ প্লাস। ৮৫-৯৫ এ গ্রেড। ৭৫-৮৪ বি গ্রেড। ৬৬-৭৪ সি গ্রেড এবং ৬৫ বা এর কম নাম্বার আইআর (ইমপ্রুভমেন্ট রিকোয়ার) অর্থাৎ তার উন্নতি প্রয়োজন বলে অভিহিত করা হবে।

উল্লিখিত গ্রেডিংয়ে যারা এ প্লাস ও এ গ্রেড প্রাপ্ত হবেন তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশংসাপত্র থাকবে। ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে তার ছবি প্রকাশ করে তার কাজের প্রশংসা করে উৎসাহ দেওয়া হবে। এছাড়া বিদেশ সফরে যাওয়ার বিষয়ে অগ্রাধিকারসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য পাঠানো হবে।

অন্যদিকে যারা নিুধাপের গ্রেড পাবেন তাদের জন্য কিছু প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকবে। এ ক্ষেত্রে তাদের ত্রুটিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নজরে আনা হবে। নিজ উদ্যোগে এবং সরকারিভাবে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া, বই-জার্নাল পড়ার পরামর্শ পাবেন তারা। সেইসঙ্গে জ্যেষ্ঠ কোনো কর্মচারীর অধীনে সংযুক্তির ব্যবস্থাও থাকছে। এসব ধাপ সম্পন্ন করে সেগুলোর প্রমাণসহ নিজের এপিএ রিপোর্টে তুলতে হবে। 

গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্যোগটি বাস্তবায়নের অর্থসংস্থানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ কোটি টাকার প্রাথমিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!