• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকায় পুলিশের বিরুদ্ধে ৬০ শতাংশই নারী নির্যাতন ও মাদকের মামলা


নিউজ ডেস্ক মে ১৩, ২০২২, ০৮:৪৮ এএম
ঢাকায় পুলিশের বিরুদ্ধে ৬০ শতাংশই নারী নির্যাতন ও মাদকের মামলা

ঢাকা: পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এসপি মোক্তার হোসেন সম্প্রতি সহকর্মীকে ধর্ষণের মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। মামলার বাদী ওই নারী পরিদর্শককে বিয়ে করায় এসপিকে অব্যাহতি দেন আদালত। মামলা হওয়ার পর বিয়ের মাধ্যমে আপস করেছেন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আপসনামা দাখিল করায় ধার্য গুরুতর অভিযোগটি বিচার পর্যন্ত গড়ায়নি।

নারী নির্যাতন, মাদকসহ নানা অপরাধের ঘটনায় সারাদেশে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গড়ে বছরে ১৮ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসে। প্রায় দুই হাজার জন নানা মাত্রায় সাজা পান।

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদস্যদের বিরুদ্ধে ২১৬টি মামলা হয়েছে। মোট ২০৬ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে। কয়েকজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। তার মধ্যে শুধু ৮৬ জনের (৪২ শতাংশ) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। মাদক-সংক্রান্ত অপরাধে মামলা হয়েছে ৩৮ জনের বিরুদ্ধে বা ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ ঢাকায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার ৬০ শতাংশই নারী নির্যাতন ও মাদকের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশের অনেক সদস্যের মধ্যে একাধিক বিয়ে করার প্রবণতা রয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ে করতে হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। আবার প্রথম স্ত্রীরও অনুমতি নেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করা যায় না। তবে অনেকে এর ব্যত্যয় ঘটান। আবার যারা কম বেতনে চাকরি করেন, তারা একসঙ্গে দুই সংসারের ভরণপোষণ করতে পারেন না। তখন প্রথম স্ত্রী মামলা করেন।

মাদক মামলার বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, একসময় পুলিশ মাদকের সঙ্গে জড়ালেও বাহিনীর সুনামের কথা চিন্তা করে ছাড় দেওয়া হতো। এখন পুলিশ সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাদক কেনাবেচা ও সেবনের সঙ্গে কোনো পুলিশের সংশ্নিষ্টতার তথ্য পেলেই এখন নিয়মিত মামলা করা হয়। এ ছাড়া বিভাগীয় মামলাও হচ্ছে।

মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, অফিসার ভুল করলে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ, তিনি অভিভাবক। কনস্টেবল যদি কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বসহ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, অনেক সময় মামলার বিচার চাইতে গিয়ে নারীরা পুলিশের হেনস্তার শিকার হন। অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে এ ধরনের প্রবণতা কমে আসবে।

ডিএমপি পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট। বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় ৩৫ হাজার সদস্য এখানে নানা পদে দায়িত্ব পালন করছেন। মামলার পরিসংখ্যান বিশ্নেষণে দেখা যায়, গত দুই বছর তিন মাসে যে ২০২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তার মধ্যে কনস্টেবল ১৬৩ জন, নায়েক তিনজন, এএসআই ২৩ জন, সার্জেন্ট দু'জন, এসআই ১২ জন এবং পরিদর্শক একজন।

মামলাগুলোর মধ্যে ১০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে রয়েছে চুরির অভিযোগ। ছয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ডাকাতি, অস্ত্র আইনে দুটি, হত্যার ধারায় মামলা হয়েছে দু'জনের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া শর্ত ভঙ্গ করে চাকরিতে প্রবেশের কারণে ১০ জন, অর্থ আত্মসাতের কারণে চারজন, জাল-জালিয়াতিতে দু'জন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে দু'জন, এনআই অ্যাক্টে চারজন, ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদানের কারণে ১২ জন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দু'জন, সড়ক পরিবহন আইনে একজন, প্রতারণার মামলা ১২ জনের বিরুদ্ধে, দস্যুতার মামলায় পাঁচজন, মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার কারণে মামলা হয়েছে একজনের বিরুদ্ধে, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার কারণে চার মামলা, চাঁদাবাজির কারণে এক মামলা, চোরাই মাল হেফাজতে রাখার কারণে এক মামলা, প্ররোচনার মামলা চারটি, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ৮৬টি। পুলিশের বিরুদ্ধে এসব মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে দু'জনের। আর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ৯ জন।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠলেও বিচারে তা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হয়। কারণ, অনেক সময় অভিযোগকারীও পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতে পারেন না। আবার তদন্ত চলাকালে সাক্ষীরা ঠিকমতো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এসপি মোক্তার হোসেন জাতিসংঘের শান্তি মিশনে পুলিশের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসেবে ২০১৯ সালের মে মাসে সুদানে যান। আর বাদী আগে থেকে মিশনের সদস্য হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর বাদীকে ধর্ষণ করেন তিনি। এটা কাউকে না বলার জন্য চাপ দেন। এর পর থেকে বিভিন্ন কৌশল করে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে সুদান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। মিশন শেষে দেশে ফিরে এসপি মোক্তারের বাসায় গিয়ে বিয়ের কাবিননামা করার তাগিদ দেন। কিন্তু এসপি মোক্তার তাতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাকে মারধর করেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সারাদেশ থেকে যেসব অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে আসছে, তার মধ্যে রয়েছে নানাভাবে হয়রানি, বিয়ের পর স্ত্রীকে ভরণপোষণ না দেওয়া ও যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মামলা দায়েরের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া, জমিজমা-সংক্রান্ত এবং পুলিশ সদস্যের হুমকির মুখে জীবনের নিরাপত্তা চাওয়ার অভিযোগ আসছে।

গত ৭ জানুয়ারি নোয়াখালীর সুধারামে ২৩ বছর বয়সী এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ওই নারীর মা বাদী হয়ে ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবলসহ চারজনকে আসামি করে মামলা করেন। অভিযুক্ত সবাইকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে ২০১৯ সালে চাকরি দেওয়া এবং বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হককে সাসপেন্ড করা হয়।

কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর যে কাউকে সাসপেন্ড করা যায়। তবে আপিলে যদি সংশ্নিষ্ট পুলিশ সদস্য অভিযোগ খ ন করতে পারেন, তাহলে আবারও তাকে চাকরিতে নিয়মিত করা হয়। অন্যথায় চূড়ান্তভাবে চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত কিংবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। কোনো অভিযোগ প্রমাণ হলে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে লঘুদ ও গুরুদণ্ডের বিধান আছে। গুরুদে র মধ্যে চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা রহিত করা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদে র বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন্স বা রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের ২০১৭ সালের পুলিশের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই বছর ১৪ হাজার ১৩৩ জনকে কনস্টেবল ও এএসআইর লঘুদ এবং ৪৮৯ জনের গুরুদ হয়েছে। একই বছর ৩৮ জন পুলিশ পরিদর্শকের লঘুদ ও আটজনের গুরুদ হয়েছে। আর ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের (সিএইচআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করেছিল, বাংলাদেশে পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের ১০ ভাগের বেশি সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হন। উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শক পদের নারী কর্মকর্তাদের শতকরা ৩ ভাগ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন। এমনকি ক্যাডার পর্যায়ের নারী পুলিশ সদস্যরাও হয়রানির বাইরে নন। তবে তখন পুলিশের নীতিনির্ধারকরা এই প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সূত্র: সমকাল

সোনালীনিউজ/এন

Wordbridge School
Link copied!