• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পিঠ ঠেকেছে দেয়ালে, বাধ্য হয়ে মাঠে সরকারি কর্মচারীরা


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ২৫, ২০২২, ০৩:১৫ পিএম
পিঠ ঠেকেছে দেয়ালে, বাধ্য হয়ে মাঠে সরকারি কর্মচারীরা

ঢাকা: বাজারে নিত্যপণ্যের উত্তাপে এক প্রকার বাধ্য হয়েই মাঠে নেমেছেন সরকারি কর্মচারীরা। জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কারণে নির্ধারিত আয়ের এসব চাকরিজীবীও দিশেহারা। দিনের পর দিন যথাযথ মাধ্যমে কথা বলে সাড়া না পেয়ে এবার তারা মাঠে নামার কর্মসূচি দিয়েছেন।

আগামী ৩ জুন শুক্রবার ঢাকার শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ করবেন সরকারি কর্মচারীরা। সারা দেশ থেকে এই কর্মসূচিতে যোগ দেবেন তারা। সমমনা কর্মচারীদের ১৪টি সংগঠন এক হয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এক মঞ্চে এসে গঠন করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি বাস্তবায়ন ঐক্য ফোরাম নামের একটি যৌথ সংগঠন। সাত দফা দাবিতে সংগঠনটি মাঠে নামার ঘোষণা দিলেও পরিবারের ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে নবম পে-কমিশন গঠনের ঘোষণা, কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা তাদের মূল দাবি।

নবগঠিত দাবি বাস্তবায়ন ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক মো. হেদায়েত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারের কর্মচারী হয়ে আমরা মাঠে যাচ্ছি। আচরণবিধি অনুযায়ী আমরা এটা করতে পারি না। কিন্তু কাজটি করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে সর্বশেষ পে-কমিশনের সময়ই বলা হয়েছিল ওটাই শেষ পে-কমিশন। এরপর আর কোনো পে-কমিশন গঠন করা হবে না। এরপর হবে স্থায়ী পে-কমিশন। কিন্তু স্থায়ী পে-কমিশন হলো না। স্বাভাবিক নিয়মে অতীতে আমরা দেখেছি পাঁচ বছর পর পর পে-কমিশন গঠন করতে। এবার সাত বছর পার হয়ে গেছে। বাজারদরের সঙ্গে আমরা নির্ধারিত আয়ের মানুষেরা আর পেরে উঠছি না।’

যেসব সংগঠন আন্দোলনে নামতে একসঙ্গে হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশন, ১১-২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরাম, বাংলাদেশ ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী সমিতি (সাবেক চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতি), বাংলাদেশ সরকারি গাড়িচালক সমিতি, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি (তোতা-গাজী), বাংলাদেশ প্রথমিক শিক্ষক সমিতি (কাশেম-শাহীন), বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ (আনিস-রবিউল), বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজ (শাহীনুর-আল আমিন), বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ তৃতীয় শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি, বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ডাক কর্মচারী উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল শ্রমিক কর্মচারী সংগঠন এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী উন্নয়ন পরিষদ।

দাবি বাস্তবায়ন ঐক্য ফোরামের মুখ্য সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি মো. ওয়ারেছ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই বছর ধরে সরকারের নানা পর্যায়ে আমরা যোগাযোগ করেছি। মন্ত্রীদের সঙ্গেও দেখা করেছি। কিন্তু আমরা কারও সাড়া পাইনি। শেষ পর্যন্ত বৈষম্য দূর করার জন্য আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আবেদন করি। সেখান থেকে আমাদের আবেদন অর্থ বিভাগে পাঠানো হলে তা নথিজাত বা ফাইলবন্দি করে রাখা হয়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়েছি সরকারি কর্মচারী হয়েও সমাবেশ করার জন্য। আশা করি, সমাবেশের আকার অর্থাৎ ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সরকার আমাদের বিষয়গুলো সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবে।’ 

মূল্যস্ফীতির মুখে সরকার ২০১৩ সালে সর্বশেষ পে-কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশের আলোকেই সরকার ২০১৫ সালে পে স্কেলে সংস্কার আনে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকের পদমর্যাদায় সভাপতি, সচিবের পদমর্যাদায় ৩ জন পূর্ণকালীন সদস্য এবং পেশাজীবীদের মধ্য থেকে ১২ জন খ-কালীন সদস্যের সমন্বয়ে অষ্টম পে-কমিশন গঠন করেছিল সরকার। কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে। এই কমিশন কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার সুপারিশ করে। পরে এই প্রতিবেদনের আলোকেই বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়।

২০১৫ সালের আগে সর্বনি্ম বেতনের ধাপ ছিল ৪ হাজার ১০০ টাকা। অষ্টম পে-কমিশন সেটা বাড়িয়ে ৮ হাজার ২০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ বেতন ৪০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা করার সুপারিশ করে। পরে সর্বনিম্ন বেতন আরও ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৮২৫০ টাকা নির্ধারণ করে চূড়ান্ত পে-স্কেলের ঘোষণা দেয় সরকার। সর্বোচ্চ বেতন ধাপের সুপারিশ বহাল রাখা হলেও ফরাসউদ্দিন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ ছিল কর্মচারীদের বৈষম্য কমানোর জন্য ২০টি থেকে গ্রেডের সংখ্যা ১৬টিতে নামিয়ে আনার। পরে ধাপে ধাপে সেই গ্রেড ১০টি নির্ধারণ করার সুপারিশ ছিল। কিন্তু সরকার গ্রেড তো কমায়ইনি, বরং বাড়িয়েছে। ২০টি গ্রেডের বাইরেও সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের জন্য আলাদা গ্রেড করা হয়।

ফরাসউদ্দিন কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল স্থায়ী পে-কমিশনের। সরকার গত সাত বছরে স্থায়ী পে-কমিশন গঠন করেনি। ২০১৭ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্থায়ী পে-কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্থায়ী পে-কমিশন গঠনের আইনিভিত্তি না থাকার কথা জানান। এরপর সরকার ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে স্থায়ী পে-কমিশন গঠনের বিধান সংযোজন করে। এখন আইনি কাঠামো থাকার পরও সরকার পে-কমিশন গঠনের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া মিলন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পে-কমিশনের দাবিতেই আমরা এক হয়েছি। আসলে কর্মচারীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সকালে একটা, আবার বিকেলে আরেকটা। পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন অনুযায়ী মা-বাবাও আমাদের সঙ্গেই থাকেন। তাদের চিকিৎসায় একটা বড় খরচ হয়। কাজেই ছয় সদস্যের একটা পরিবার চলে কী করেএটা কি কেউ ভেবেছেন?’ তিনি বলেন, সরকারের সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ৮২৫০ টাকা। বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ সব মিলিয়ে তাদের বেতন হয় ১৭ হাজারের কিছু বেশি। সরকারি বাসায় থাকলে তার বাড়ি ভাড়া কাটা হয় ৭ হাজার ৫০০ টাকা। অবশিষ্ট থাকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার কোনোভাবেই চলে না।

নিজামুল হক বলেন, ‘আমাদের হিসাবের পয়সা। টেনেটুনে ১৫ দিন হয়তো কোনোভাবে চলে। তারপরই ধারকর্জ করতে হয়। ধারকর্জ কয়দিন পাওয়া যায়? তারপরই শুরু হয় অন্য ধান্ধা। অনিয়ম করা ছাড়া, সোজা কথায় দুর্নীতি করা ছাড়া বাড়তি টাকা আয়ের বিকল্প কোনো সুযোগ নেই। হয় ফাইল আটকিয়ে পয়সা নেবে, না হলে মিথ্যাচার করে টাকা কামাই করবে। এই প্রক্রিয়াই প্রশাসনে চলছে।’

কর্মচারী সংগঠনগুলো নতুন পে-কমিশন ও মহার্ঘ ভাতা ছাড়াও যেসব দাবি জানিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণি করা, আউটসোর্সিং বন্ধ করা, ১১ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ করা, গৃহঋণ সুবিধা, রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত কর্মচারীদের শুরু থেকে চাকরিকাল গণনা এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার পাশাপাশি অবসরের বয়স ৬২ বছর করা।

বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শাহ মো. মামুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফরাসউদ্দিন কমিশনের মূল দুটি সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ এ দুটি সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈষম্য অনেকটাই কমে আসত। কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের বৈষম্য আরও বেড়েছে নতুন পে স্কেল দেওয়ার পরও কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সুযোগ দেওয়ায়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উপসচিবদের গাড়ির সুবিধা নগদায়ন। অর্থাৎ উপসচিবরা গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা বিনা সুদে ঋণ পাচ্ছেন আর সেই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে ৫০ হাজার করে টাকা পাচ্ছেন। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের প্রাপ্যতা, ডমেস্টিক এইড অ্যালাউন্স ও টেলিফোন বিল নগদায়ন করার মাধ্যমেও বৈষম্য বেড়েছে।’

সূত্র-দেশরূপান্তর

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!