• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান

‘খামাখা খামছি দিয়ে লাভ নেই, ধরলে ধরার মতো ধরতে হবে’


নিউজ ডেস্ক অক্টোবর ১৯, ২০২২, ০২:৩৪ পিএম
‘খামাখা খামছি দিয়ে লাভ নেই, ধরলে ধরার মতো ধরতে হবে’

ঢাকা: প্রশাসনে কর্মরত সাধারণ কর্মকর্তারা চান একটি দায়িত্বশীল পেশাদার গণমুখী প্রশাসন। যেখানে সংবিধানের ভাষায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কোনো দলকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা যেমন করবে না, তেমনি কোনো সরকারকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়া ষড়যন্ত্রও করবে না। 

আমলারা আইন ও বিধিবিধানের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। কারণ দেশ চালাবেন রাজনীদিবিদরা। 

সংবিধান, সংসদ এবং সরকার সবার ওপরে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের সেবক হিসাবে কর্মচারীর মতো কাজ করবেন। 

তবে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেছেন, কয়েক দশক ধরে প্রশাসনে দলাদলি আর ব্যক্তিস্বার্থের প্রতিযোগিতায় যে নোংরা সংস্কৃতি চালু হয়েছে এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে পচন ধরেছে, তার একটা বিহিত হওয়া দরকার। এজন্য প্রয়োজন সত্যিকারের শুদ্ধি অভিযান। আর সেটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দ্বারাই সম্ভব। 

সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রায় সময় আমরা মন্ত্রীদের মুখে বলতে শুনি-দল ও প্রশাসনের মধ্যে নানারকম ভূত ঢুকে পড়েছে। যাদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। কয়েকটি শব্দ তো সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। যেমন-হাইব্রিড, কাউওয়া, অনুপ্রবেশকারী, ষড়যন্ত্রকারী ইত্যাদি। কিন্তু এ নিয়ে খোদ সরকারপন্থি কর্মকর্তাদেরও অনেকের প্রশ্ন। তারা বলেন, এত তথ্য যখন আমরা জেনে ফেলেছি এবং বাস্তবে এসব অভিযোগ ও অনুমানের অনেকখানি তো সত্যও বটে, তাহলে এদের বিরুদ্ধে কার্যকর শুদ্ধি অভিযান শুরু হচ্ছে না কেন? কবে সেই শুদ্ধি অভিযান হবে। একেবারে সময় চলে গেলে, না নির্বাচন শেষ হলে? 

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সব সময় বলে আসছি, লিখে আসছি-প্রশাসন হবে দলমতের ঊর্ধ্বে। সবাই পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করবেন। কেউ রাজনীতি করবেন না। রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদরা। কর্মচারীরা কাউকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন চেষ্টা করবেন না, তেমনি কাউকে ক্ষমতায় আনার জন্যও ভূমিকা রাখবেন না। একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক দেশের জন্য দলমত নিরপেক্ষ প্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই। এটা খুবই জরুরি।’ 

প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান প্রসঙ্গে সাবেক সচিব এবং প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবু আলম মো. শহিদ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবকিছু দেশে প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। কেউ কোনো অন্যায় করে থাকলে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া কোনো সমাধান নয়। তাকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ ওই ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড করার সাহস না করে। এছাড়া যে বা যারাই প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযানের দাবি তুলুক না কেন, কোনো লাভ হবে না। আসলে বিড়ালের গলায় কেউ ঘণ্টা বাঁধতে চাইবে না।’ তাছাড়া তিনি মনে করেন, ‘যতদিন দল এবং রাজনীতিতে প্রকৃত শুদ্ধি অভিযান হবে না, ততদিন প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান ওই অর্থে কার্যকর ও সফল হবে না। যেমন সফল হয়নি ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান। তাই লোক দেখানোর জন্য খামাখা একটু খামছি দিয়ে লাভ নেই। ধরলে ধরার মতো সবাইকে ধরতে হবে।’

সরকারি দল সমর্থক বলে পরিচিত সাবেক ও বর্তমানে কর্মরত বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরাও কখনো চাইনি প্রশাসনে নোংরাভাবে দলীয়করণ করা হোক। তবে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে যেভাবে প্রশাসনকে দলীয়করণ করে শত শত কর্মকর্তাকে পদোন্নতিবঞ্চিত, চাকরিচ্যুত করাসহ নানাভাবে হয়রানির রেকর্ড তৈরি করা হয়েছিল তা থেকে পুরো জাতি মুক্তি চেয়েছিল। পাশাপাশি সবার দাবি ছিল, যেন জড়িতদের শাস্তি হয় এবং ক্ষতিগ্রস্তরা কিছুটা হলেও বেনিফিট পায়। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে একটি প্রতিকার কমিটিও করে দেন। তারপর অনেকে চাকরি ফিরে পান। এছাড়া কিছু কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই জোট সরকার আমলের ৮০ শতাংশ (চারদলীয় জোট সরকারপন্থি) আমলারা রাতারাতি সব আওয়ামী লীগার হয়ে গেল। পরে দিনকে দিন তাদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। পরে দেখা গেল সবাই আওয়ামী লীগ।
 
অথচ সত্যিকারার্থে যারা বিএনপি সরকারের সময়ে জীবন ও চাকরির ঝুঁকি নিয়ে সচিবালয়ে সরব ছিলেন, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন, ওই সময়কার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কক্ষের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন, জনপ্রশাসন সচিব সোলায়মান চৌধুরীর রুম যারা ঘেরাও করেছিলেন পদোন্নতির জন্য-তাদের কথা রাতারাতি অনেকে ভুলে গেলেন। বাস্তব তথ্য হলো-প্রকৃত আওয়ামী লীগ করা এবং একই সঙ্গে পেশাদার সেসব আমলার অনেকের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। বরং সরকারের প্রথম দুবছরের মাথায় এসে আমরা দেখতে পেলাম-একশ্রেণির সুবিধাবাদীদের দখলে সব গুরুত্বপূর্ণ পদ চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একে একে খাঁটি ও ডেডিকেটেড আওয়ামী কর্মকর্তাদের কৌশলে বের করে দেওয়া হলো। চলে আসতে হলো ৮৪ ব্যাচের আব্দুল মালেককে, ১৫তম ব্যাচের খাইরুল ইসলামকে তারও আগে সরানো হলো। কিছুদিন কবির বিন আনোয়ারের ঠাঁই হলেও তিনিও বেশিদিন সেখানে থাকতে পারেননি। আর বিএনপি সরকার এবং ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে সবচেয়ে যে কর্মকর্তা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রশাসনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন-সেই আবু আলম শহিদ খানকে অনেকটা মূল্যায়ন করা হলেও শেষদিকে তাকে সতীর্থদের ষড়যন্ত্রের কাছে হার মানতে হয়। ১০ম ব্যাচের কর্মকর্তা প্রতিবাদী খাজা মিয়া শেষ পর্যন্ত সচিব হতে পারলেও ওই সময়কার আন্দোলনের সহযোদ্ধা আজাহার আলী খানকে সচিব করা হয়নি। তাকে গ্রেড-১ এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে ৮৫ ব্যাচের সেই তুখোড় প্রতিবাদী অমিত কুমার বাউলকে। যিনি বিএনপি সরকারের সময়ে বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েও জোরাল কণ্ঠে সব সময় প্রতিবাদী ছিলেন। কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সচিব থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। সম্ভবত মনের দুঃখে তিনি এখন বিদেশে থাকেন। ১০ম ব্যাচের হায়াততুল্লাহকে সচিব করা হয়নি। সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে গ্রেড-১। ৮৫ ব্যাচের মুহিবুল হক সচিব হতে পারলেও বিমানে তাকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। বিমানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক রকম একাই লড়াই করে বিমানকে তিনি লাভে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও ক্রিজে টিকতে পারেননি। 

ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বলেন, এ রকম বহু কর্মকর্তার আত্মত্যাগ রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য। কিন্তু তাদের অনেককে উলটো হেনস্তা ও কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। বিপরীতে একশ্রেণির আমলারা প্রশাসনে পরিবারতন্ত্র চালু করেছেন। নিজে সচিব হওয়া ছাড়াও পরিবারের লোকজনকেও সচিব করতে মরিয়া ছিলেন। তাদের চক্রান্তে ৮৫ ব্যাচের অনেক যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তা সচিব হতে পারেননি। ৮৪, ৮৫, ও ৮৬ থেকে শুরু করে নিচের দিকেও অনেকে মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত সচিব করে শুধু আশ্বাস দিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হয়। সামনে ১৩তম ব্যাচ থেকে সচিব করা হবে। অথচ ১০ম ও ১১ ব্যাচের অনেক দক্ষ কর্মকর্তা এখনো সচিব হতে পারেননি। খুবই দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তা হওয়ার পরও ৮৫ ব্যাচের আহসানুল জব্বারকে সচিব করা হয়নি। 

তবে এতকিছুর পরও এমন কয়েকজন কর্মকর্তাকে সচিব করা হয়েছে যারা এ সরকারের জন্য ব্যাপক সাফল্য এনে দিয়েছেন। এর মধ্যে বর্তমানে প্রথম সারিতে আছেন ভূমি সচিব মোস্তাফিজুর রহমান। ১০ম ব্যাচের এ কর্মকর্তার নেতৃত্বে ভূমি মন্ত্রণালয়ে গত এক বছরে যে রকম সংস্কার ও অগ্রগতি হয়েছে তা গত ৫০ বছরেও হয়নি। শতভাগ ডিজিটাল সচিব। সঙ্গে পেয়েছেন একজন সৎ ও দক্ষ মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে। আছে প্রদীপ কুমার দাসের মতো পরীক্ষিত অতিরিক্ত সচিব। মোদ্দা কথা, একটা চৌকস ও সৎ টিমের কারণে ভূমি মন্ত্রণালয়ে এখন অনিয়ম, দুর্নীতি ও জনহয়রানি অনেকখানি কমে গেছে। অনেকে বলেন, যদি কোনো সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে অনেকদিন রাখতে হয় তাহলে প্রথম সারিতে নাম থাকতে হবে মোস্তাফিজুর রহমানের। সাম্প্রতিক সময়ে আরও একজন সচিব নিয়োগের সিদ্ধান্ত খুবই প্রশংসিত হয়েছে। তিনি হলেন কাজী ওয়াছি উদ্দিন। ৯ম ব্যাচের এ কর্মকর্তা একজন শতভাগ সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে অতীতে কখনো এ রকম পরীক্ষিত সৎ অফিসার সচিব হিসাবে নিয়োগ পাননি। যদিও অনেক পরে তাকে সচিব করা হয়েছে। বরং এ ধরনের কর্মকর্তাদের আরও আগে সচিব করা দরকার ছিল। 

সূত্রমতে, এ মন্ত্রণালয়ে সচিব হওয়ার জন্য অনেকে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। যেসব খবর বাতাসে এখনো ভাসছে। 

রাজউক চেয়ারম্যান হিসাবেও অনেকদিন পর আনিছুর রহমান মিয়ার মতো একজন খুবই সৎ ও যোগ্য আমলাকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে। তাকে দিয়ে আর যাই কিছু হোক না কেন, কেউ অন্যায় কাজ করাতে পারবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এপিডি অতিরিক্ত সচিব থাকাবস্থায় তিনি এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রেখেছেন। যে কারণে এই দক্ষ কর্মকর্তাকে সচিব হতে বাগড়া দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার হোসেন। শতভাগ সরকারের আস্থাভাজন ভালোমানের একজন কর্মকর্তা। যদিও তার চাকরি বেশিদিন নেই। যুব ও ক্রীড়া সচিব মেজবাহ উদ্দিন শতভাগ পেশাদার আমলা। সরকারের গুডবুকে থাকা এ কর্মকর্তার চাকরিও বেশিদিন নেই। এর আগে এক সময় ছিলেন ইকবাল মাহমুদ ও আতাহারুল ইসলাম, সামসুদ্দিন আজাদ চৌধুরীর মতো জাঁদরেল সচিব। তারা ছিলেন পেশাদার ও সাহসী সচিবের বিরল দৃষ্টান্ত। 

সূত্র-যুগান্তর

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!