• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
সাইমন জন ড্রিং

ডানপিটে ছেলেটির কিংবদন্তী হয়ে ওঠার গল্প


এস এম সাব্বির খান জুলাই ২১, ২০২১, ০৭:১৩ এএম
ডানপিটে ছেলেটির কিংবদন্তী হয়ে ওঠার গল্প

ঢাকা : ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন জন ড্রিং। ছোট বেলা থেকেই প্রকৃতির মতো স্বাধীনচেতা আর ডানপিটে স্বভাবের সাইমন বেড়ে ওঠেন ইংল্যান্ডের নরফোক অঙ্গরাজ্যের ফেকেনহ্যামে। গতানুগতিকতার ঘোর বিরোধী সাইমনের চোখে ছিল পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর স্বপ্ন। স্কুল জীবনে তিনি ছিলেন বেশ দুরন্ত স্বভাবের। উডব্রিজের বোর্ডিং স্কুলে পড়াকালে নদীর হিম শীতল জলের বুকে মধ্যরাতের সাঁতার কাটার বেপরোয়াপনার দায়ে বহিষ্কার করা হয়েছিল তাকে। পরে তিনি কিংস লিন টেকনিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন।

১৯৬২ সালে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান সাইমন ড্রিং। ইউরোপ এবং মধ্য প্রাচ্যের নানা দেশ ঘুরে এসেছিলেন ভারতবর্ষেও। কিন্তু তখনও কি তিনি জানতেন মাত্র একযুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে এই উপদেশেরই কোনো একটি অঞ্চলের মুক্তিকামী জনতা ও তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত পাণ্ডুলিপি হয়ে উঠবেন তিনি? হয়ে উঠবেন বাংলা ও বাঙালি জাতির অমিত মিত্র?

কারিগরি বিষয়ে পড়ালেখা করলেও ড্রিংয়ের ভালোবাসায় পরিণত হয় সাংবাদিকতা। পরবর্তীতে সেই ভালোবাসাকেই জীবন ও জীবিকার পাথেয় হিসেবে ধারণ করেন তিনি। শুরু হয় দুঃসাহসি সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের রোমাঞ্চকর পথচলা।

১৯৬৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রথম গণমাধ্যমে যোগ দেন সাইমন। থাইল্যান্ডের দ্য ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড পত্রিকার প্রুফরিডার এবং ফিচার লেখক হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি। এর মাত্র এক বছর পরে ১৯ বছর বয়সী ড্রিং ফ্রিল্যান্সার হিসেবে একই সঙ্গে লন্ডনের ডেইলি মেইল​এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে কাজ শুরু করেন। ১৯৬৪ সালের শেষদিকে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের সর্বকনিষ্ঠ সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে দুই বছরের জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পান ড্রিং।

এরপর ড্রিংকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বিশ্বের স্বনামধন্য সব সংবাদমাধ্যমের প্রাঙ্গণ। সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে ড্রিং সান ডে টাইমস, নিউজ উইক, বিবিসি, রয়টার্স এবং দ্য টেলিগ্রাফের মতো শক্তিশালী সব সংবাদমাধ্যমে সুনামের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।

সাল ১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা দেশের অজস্র সহমর্মী মানুষ। যুদ্ধের মাঠে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে,ন কূটনৈতিক ক্ষেত্রে, শরণার্থী শিবিরে, প্রতিবাদে বা জনমত গঠনে কঠিন সেই সময়ে তাঁরা ভূমিকা রেখেছিলে নিজ নিজ জায়গা থেকে। যাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন বিলাতি দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর রিপোর্টার সাইমন ড্রিং।

তিনি তখন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে কাজ করছেন। লন্ডনের সদর দপ্তর থেকে ফোন করে তাঁকে বলা হলো, -‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’

সাইমন অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছিলেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই ছিল না। তবু তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় আসলেন। পরদিন ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি প্রত্যক্ষ করলেন তিনি। যদিও একটি বাংলা শব্দও তাঁর বোধগম্য ছিল না, কিন্তু লাখ লাখ জনতার প্রতিক্রিয়া, তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে অনুভব করলেন, তিনি উপস্থিত হয়েছেন বিরাট এক রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভীষণ বিক্ষুব্ধ, তারা ‘জয় বাংলা’ চায়। সংকল্প ও আশায় উদ্দীপিত চোখে তারা চেয়ে আছে বাঙালির মুক্তির কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দিকে।

সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকা এসে সাইমন ড্রিং আর ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারলেন না। পাকিস্তানের রাজনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন–সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শুরু হলো। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। সখ্য গড়ে উঠল অনেকের সঙ্গে। সর্বশেষ রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে লাগলেন লন্ডনে।

সাইমন উঠেছিলেন ঢাকার শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। সেনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। অবরুদ্ধ বিদেশি সাংবাদিকেরা সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান, কেউ কেউ জানালা দিয়ে দেখতে পান আগুন। পরদিন সকালেই তাঁদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। তারপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন।

ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ সেটা ছাপা হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সঞ্চারের প্রাথমিক মুহূর্ত ছিল সেটি।

৩০ মার্চ সাইমনকে লন্ডন চলে যেতে হয়। তারপর কলকাতায় আসেন নভেম্বরে; সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।

১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সাইমনের। সাইমন তাঁকে জানান, ২৫ মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার সময় তিনি লুকিয়ে থেকে গিয়েছিলেন। এরপর প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমাকে খুঁজে পেলে তোমরা কী করতে?’ সিদ্দিক সালিক বলেছিলেন, ‘গুলি করে মারা হতো।’

এরপর সাইমন ড্রিং স্বাধীন বাংলাদেশে আবারও এসেছিলেন ২০০০ সালে। দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ে তোলার প্রধান কারিগর তিনি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশে টিভি বন্ধ করে দেয়। ২০০২ সালের অক্টোবরে সরকার সাইমন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাঁকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের আদেশ দিলে তিনি চলে যান।

বিশ্ব গণমাধ্যম জগতের কিংবদন্তী তুল্য এই সাংবাদিক আমাদের ছেড়ে চির দিনের মতো চলে গেলেন। কিন্তু সাইমন ড্রিং চোখের আড়াল হলেও কালের গহবরে হারিয়ে যাবেন না। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অনবদ্য কীর্তিতে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ যতদিন থাকবে, যত দিন বাঙালির মুক্তিকামী সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস থাকবে। সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মকথন যতদিন আলোচিত হবে যুগে যুগে তাঁর পরতে পরতে প্রতিধ্বনিত হবে বাংলা ও বাঙালির বন্ধু চিরঞ্জীব সাংবাদিক সাইমন জন ড্রিংয়ের নাম। বিদায় বন্ধু। তোমাকে কখনো ভালোবাসতে ভুলবে না বাংলাদেশ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!