• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি পেলেন এক সরকারি চাকরিজীবী


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ১৫, ২০২০, ০৯:০৯ এএম
মানবেতর জীবন থেকে মুক্তি পেলেন এক সরকারি চাকরিজীবী

ঢাকা: জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের নির্দেশে ৫ বছরের সীমাহীন দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেলেন মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বাদিউল কবীর।

সম্পূর্ণ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও যাকে প্রায় ৬ বছর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হয়। বিভাগীয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বারবার তাগিদ দেয়ার পরও সরকার পক্ষে নথি উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা অভিযোগের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণাদি উপস্থাপন না করে মাসের পর মাস সময়ক্ষেপণ করেছেন। এতে করে মামলার তদন্ত শেষ হতেই ৩ বছর পার হয়েছে। উপরন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার পরও ফাইলটি নিষ্পত্তি না করে দায়িত্বশীল পদস্থ কর্মকর্তারা আরও ১ বছরের বেশি সময় ফেলে রাখেন। এমনকি গত ৮ মাস ধরে তার অর্ধেক বেতনও বন্ধ করে দেয়া হয়। এর ফলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চরম মানবেতর অবস্থায় পড়ে যান বাদিউল কবীর।

সন্তানদের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালানোর জন্য যা কিছু ছিল বিক্রি করে তিনি এক রকম নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ধারদেনার পথও বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ক্লাসে প্রবেশ করে তিনি সচিবের কাছে তার প্রতি এ অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করেন। পুরো ঘটনা শুনে সচিব চরম হতবিহ্বল ও ক্ষুব্ধ হন এবং তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফাইল নিষ্পত্তি করে দেন। সচিবের এ সাহসী ও মহতী উদ্যোগের ফলে চাকরি ফিরে পেয়েছেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীও সচিবকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

এদিকে সূত্র জানায়, শুধু চাকরি ফেরত দিয়েই সচিব বিষয়টির ইতি টানেননি। যাদের কারণে ভুক্তভোগী ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এভাবে নাজেহালের শিকার হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।

সেদিন যা ঘটেছিল: দিনটি ছিল ১৯ অক্টোবর সোমবার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ক্লাস শুরু হয় সকাল সাড়ে ৯টায়। ক্লাস নিচ্ছিলেন স্বয়ং সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। প্রশিক্ষণ ক্লাস শেষে তিনি কারও কোনো সমস্যা কিংবা বক্তব্য আছে কিনা জানতে চাইলে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বাদীউল কবীর নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলার অনুমতি চান। সাময়িক বরখাস্ত থাকাকালীন সময়ে কেউ কর্মস্থলে যোগ দিতে পারে না এবং এ ধরনের প্রশিক্ষণ ক্লাসে আসারও অধিকার নেই। সচিবের এমন মন্তব্য শোনার পর বাদিউল কবীর মানবিক কারণে তার বিষয়টি শোনার জন্য অনুরোধ জানান। এরপর তিনি পুরো বিষয়টি উপস্থিত সবার সামনে তুলে ধরেন। কিভাবে প্রায় ৬ বছর ধরে তিনিসহ তার পরিবারকে মিথ্যা বিভাগীয় মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। বেতন না পেয়ে কিভাবে তিনি অর্থাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তা সবিস্তারে উপস্থাপন করেন। হেনস্তা হওয়ার করুণ কাহিনী শুনে সচিবের পাশাপাশি উপস্থিত ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এ সময় ক্ষুব্ধ সচিব তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে ফোন দেন। ওই কর্মকর্তার জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় তাকে ভর্ৎসনা করে নথি তলব করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের হয়রানি অন্যায় বরদাশত করা হবে না। বিভাগীয় মামলায় দায়ী করা হলে তাকে শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হলে ফাইলটি দ্রুত নিষ্পত্তিও করতে হবে। তিনি আশ্বাস দেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।

সূত্র জানায়, সচিবের যে কথা সেই কাজ। তিনি পরদিন বেলা ১১টার মধ্যে নথিটি নিষ্পত্তি করে বাদিউল কবীরকে অব্যাহতি দেয়ার চূড়ান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, প্রশাসন শাখা থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি করতে আরও ৫ দিন সময় নেয়া হয়। ২৫ অক্টোবর প্রশাসন শাখা থেকে চিঠি ইস্যু করে তার সাময়িক বরখাস্তের আদেশটি বাতিল করা হয়। সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী এখন বেতন সমন্বয়সহ প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা প্রদানের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে।

যে কারণে বিভাগীয় মামলা: বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে অভিযোগ এনে বলা হয়, বাদিউল কবীর ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতার কার্যালয়ে গিয়ে আরও কিছুসংখ্যাক কর্মকর্তাসহ গোপন বৈঠকে যোগ দেন। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে এটি অসদাচরণের অপরাধ। এ বিষয়ে বিভাগীয় মামলা করে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব সেবাস্টিন রেমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি উভয়পক্ষের শুনানির জন্য ২০১৫ সালের ২৯ জুন থেকে ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ দফা দিন ধার্য করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষে নথি উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা ১১ দফায় গরহাজির ছিলেন। শুধু সময়ক্ষেপণ করা হয়। কিন্তু অভিযোগের সপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ শেষ পর্যন্ত উপস্থাপন করতে পারেননি। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর বিভাগীয় মামলার শুনানির নোটিশে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘সরকার পক্ষে নথি উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা কর্তৃক আনীত অভিযোগের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণাদি উপস্থাপনের জন্য বারবার সময় চাওয়া এবং অদ্যাবধি কোনো ধার্য তারিখে তথ্য-প্রমাণাদি উপস্থাপন না করায় বিভাগীয় মোকদ্দমার তদন্ত কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’

এ অবস্থায় ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট ১২৭ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, আনীত অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি এবং অপরাধের দায় হতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তারপরেও আরও ১৫ মাস নথিটি নিষ্পত্তি না করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ফেলে রাখেন। অথচ বিষয়টির সত্যতা যাচাই না করে তাকে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সূত্র জানায়, বৈঠকের ঘটনাটি সত্য। তবে এ বিষয়ে যেসব কর্মচারী নেতা সেদিন গণমাধ্যমে খবরটি দিয়েছিলেন তারা প্রতিপক্ষ কয়েকজনকে ফাঁসিয়ে দিতে নিরপরাধ কয়েকজনের নাম যুক্ত করে সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহ করেন। এর ফলে একপর্যায়ে চরম আর্থিক কষ্ট থেকে লাঘব পেতে তিনি গত বছর ৬ জুন ৩ লাখ টাকার মানবিক সাহায্যের মঞ্জুরি চেয়ে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে আবেদন করেন। সেখানে তিনি এক স্থানে লেখেন, ‘সুষ্ঠু তদন্তে নিশ্চিতভাবে একদিন আমি নির্দোষ প্রমাণিত হব, কিন্তু আমার হারানো দিনগুলো আর কোনোদিন ফিরে পাব না। আমার মেধাবী সন্তানদের একজন গত বছর এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং অপরজন এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে লেখাপড়া করছে। তাই আমার মেধাবী সন্তানদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ জীবনের বিষয়টি বিবেচনা করে মানবিক সাহায্য মঞ্জুর করার আবেদন জানাচ্ছি।’

এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে বাদিউল কবীর বিভিন্ন সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে অন্তত চারটি লিখিত আবেদন করেন। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর, ২০১৮ সালের ২৬ জুন, একই বছর ১৮ সেপ্টেম্বর এবং ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর শেষ আবেদনটি করা হয়। তবে শেখ ইউসুফ হারুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার পর বিষয়টি তার নজরে এই প্রথম আসে।

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!