• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডায়েট-ফ্যাশনে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি!


নিউজ ডেস্ক সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১, ০৩:২০ পিএম
ডায়েট-ফ্যাশনে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি!

ঢাকা : বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! কিছুটা হয়তো, বেশিরভাগটাই তো অজানা। আর এই না জানা বিষয় অনেক সময় বয়ে আনে উটকো বিপদ।

এই ধরুন, হালের নায়িকা নুসরাত ফারিয়া ওজন কমানোর জন্য দিনে কয়টা করে ডিম খান- সে গল্পের খোঁজে পত্রিকার পাতায় ভক্তদের চোখ। শরীর ঠিক রাখতে বলিউড বাদশা শাহরুখ খান এককালে দিনভর শুধু তন্দুরি চিকেন খেতেন বলেও শোনা যায়। আর সেসব চার্ট দেখে অনেকেই নিজের লাইফস্টাইলের পরিকল্পনা সাজান। তারকাদের মতোই চেহারা পেতে হবে যে! অথচ বয়স, উচ্চতা, ওজন, শারীরিক অবস্থাসহ আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে তবেই একজনের জন্য উপযুক্ত ডায়েট চার্ট তৈরি করা হয়। সেটিও করেন কোনো বিশেষজ্ঞ, যা কখনো অন্যের জন্য কার্যকর নয়।

ইদানিং আবার চটজলদি ওজন কমানোর জন্য বাঙালিদের মধ্যে কিটো ডায়েট মেনে চলার হিড়িক পড়েছে। মাত্র এক সপ্তাহ মেনে চললেই কেল্লাফতে! ওজন কমে যায় কয়েক কেজি। ভয়টা সেখানেই। কারণ এ ডায়েটকে বেশিরভাগ চিকিৎসকই বলছেন অস্বাস্থ্যকর। তাদের মতে, সুস্থ শরীরকে অসুস্থ করে তুলতে এর জুড়ি মেলা ভার! কেননা না জেনে, না বুঝে কতটা খেলে বা কতটা না খেলে বিপদ হতে পারে- সেটা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। আর এ কারণেই সমালোচনার মুখে পড়েন ডা. জাহাঙ্গীর কবির, যিনি বাংলাদেশে সাধারণের কাছে কিটো পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন।

কিটো ডায়েট বা কেডিতে প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট, প্রোটিন খাওয়া হয়। সে তুলনায় কার্বোহাইড্রেট কম থাকে। এটা সাধারণত ডায়াবেটিক রোগীর জন্য খুব সহায়ক। কারণ তাদের রক্তে ইনসুলিন ও সুগারের মাত্রা কম থাকে।

পুষ্টিবিদরা বলছেন, এই ডায়েট মৃগী রোগ আছে এমন শিশুদের জন্যও উপকারী; কিন্তু অনেকেই না জেনে, না বুঝে শুধু ওজন কমানোর জন্য এই ডায়েট অনুসরণ করেন। অথচ খাবারে কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনের মাপ ঠিক রাখতে না পারলে শরীরে কিটো বা কিটোসিস নামে এক ক্ষতিকর পদার্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এতে মাংসপেশি ক্ষয়ে যায়। ক্লান্তি, অপুষ্টি, পানিশূন্যতা, হৃদস্পন্দনের ত্রুটিজনিত রোগ, গলস্টোন ইত্যাদির আশঙ্কা তো থাকেই। আবার ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে কম খাবারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওষুধের মাত্রা না কমালে, সুগার বা রক্তচাপ অনেক কমে গিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে। কাজেই চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ ছাড়া ডায়েট শুরু মানেই মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ জানানো।

সম্প্রতি ডা. জাহাঙ্গীর কবিরকে নিয়েও বিতর্ক উঠেছে যে, তিনি অপচিকিৎসা দিচ্ছেন। তার চিকিৎসা নিয়ে কারও স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে, আবার কেউ মারাও গেছেন।

ওয়াশিংটনের ফিজিশিয়ানস কমিটি ফর রেসপন্সিবল মেডিসিনের নিউট্রিশন এডুকেশন ম্যানেজার ও পুষ্টিবিদ লি ক্রসবি সম্প্রতি কিটো ডায়েট নিয়ে বিশ্লেষণমূলক গবেষণা করেছেন। তার সেই গবেষণা প্রকাশিত হয় ‘ফ্রন্টিয়ারস অব নিউট্রিশন’ শীর্ষক সাময়িকীতে। সেখানে তিনি ওই খাদ্যাভ্যাসকে বিপজ্জনক আখ্যা দেন। লি দাবি করেন, কিটো ডায়েটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাতটি প্রাণঘাতী রোগ। এর মধ্যে কয়েকটি আবার ওই খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে নিরাময় হয় বলে ধারণা সাধারণ মানুষের। অথচ কিটো ডায়েট হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এই খাদ্যাভ্যাস অনুসরণের কারণে অনেকের রক্তেই কোলেস্টেরল বাড়তে দেখা গেছে। যাদের কিডনির দুর্বলতা আছে তাদের কিডনি হয়ে যেতে পারে একেবারে অকেজো। এমন কি কিডনিতে পাথরসহ বিভিন্ন জটিলতা, গলব্লাডার স্টোন, প্যানক্রিয়াসের জটিলতা, থাইরয়েডের সমস্যা, হজমশক্তি কমে যাওয়া, চুলপড়া বেড়ে যায়। মস্তিষ্কের প্রধান খাবার হলো গ্লুকোজ, যা স্বাভাবিক অবস্থায় শর্করা ভেঙে তৈরি হয়। তাই দীর্ঘমেয়াদে কিটোতে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়াও ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, হারিয়ে যায় ত্বকের উজ্জ্বলতা।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিসটিকসও ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২৪ হাজার ৮২৫ জনের ওপর এ বিষয়ে একটি গবেষণায় জরিপ চালায়। এতে দেখা গেছে, কম শর্করাগ্রহণকারীদের হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোক এবং ক্যান্সারে মৃত্যুর আশঙ্কা যথাক্রমে ৫১, ৫০ ও ৩৫ শতাংশ বেশি। আর এসব কারণে দেশ-বিদেশের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা কিটোর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে বেশ সরব হয়েছেন।

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটলজিস্ট ও পাবলিক হেলথ নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট ডা. মৌসুমী আফরিন ইভা বলেন, ‘কিটো আসলে সর্বসাধারণের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত কোনো ডায়েট নয়। মূলত থেরাপডিউডিক ডায়েট হিসেবে এপিলেপসি বা মৃগী রোগীদের জন্য গবেষণার মাধ্যমে এ খাদ্য তালিকাকে সাজানো হয়েছিল। এসব রোগীর সুস্থতার কথা মাথায় রেখেই অনেক প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানকে বাদ দেওয়া এ তালিকা থেকে। বরং হাই ফ্যাট, হাই প্রোটিন ও অল্প কার্বোহাইড্রেট দিয়ে এ ডায়েট চার্ট সাজানো হয়; কিন্তু নির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কারের পর সেটিও গ্রহণযোগ্য নয় বলে বলা হয়েছে। কারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে অতিরিক্ত ওজন হ্রাসের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতাও দেখা দিত এই খাদ্যাভাসের কারণে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বাভাবিক ডায়েটে আমরা দৈনিক শক্তির চাহিদার ৫৫-৬০ শতাংশ পাই কার্বোহাইড্রেট থেকে, ১৫-২০ শতাংশ প্রোটিন এবং ২৫-৩০ শতাংশ পাই ফ্যাট থেকে; কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন কিটো ডায়েট করেন, তখন তার খাদ্যের ৭৫ শতাংশ নেন ফ্যাট-চর্বি থেকে, ২০ শতাংশ প্রোটিন-আমিষ এবং মাত্র ৫ শতাংশ নেন কার্বোহাইড্রেট-শর্করা থেকে। ফলে নানারকম পুষ্টি উপাদানের অভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, দেখা দিতে পারে নানা রোগ। কিটো ডায়েট শুরুর প্রথম দুই-তিন সপ্তাহ ঝুঁকি কম হলেও দীর্ঘমেয়াদে মাথা ঘোরানো, মাথাব্যথা, শরীরকাঁপা, বুক ধড়ফড় করা, বমিবমি ভাবসহ কাজে অমনোযোগী হওয়া, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস, মেজাজ খিটখিটে বা হঠাৎ রেগে যাওয়া, সারাদিন পানির পিপাসা পাওয়াসহ নানা লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। অনেক মেয়ের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সমস্যা হয় এবং পরবর্তীতে রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমসহ বাচ্চা ধারণক্ষমতাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।’

ডা. জাহাঙ্গীর কবির অবশ্য বলছেন, ‘কিটো ডায়েট নিয়ে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে। জেকে লাইফস্টাইলকে তারা এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন। আমরা কিন্তু কিটো নিয়ে সরাসরি কাজ করি না। মূলত সুস্থ খাবার নিয়ে কাজ করি। বিশেষ করে ন্যাচারাল ও অর্গানিক খাবারসহ বিভিন্ন সুস্থ খাবারের কথা বলছি। আমরা যে ভেজাল খাবারগুলো খাচ্ছি, সেগুলোর কারণেই এত রোগ। যখন সুস্থ খাবার খাবো, তখন সেগুলো রোগ থেকে ভালো করবে। আমাদের এ পদ্ধতি ফলো করে কেউ যখন ডায়াবেটিস কিংবা ব্লাড প্রেসার থেকে ভালো হচ্ছেন এবং লাইফস্টাইল পাল্টিয়ে অনেক ওষুধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন, তার মানে তিনি দিন দিন সুস্থতার দিকে ফিরে আসছেন।’

এ দিকে জেকে লাইফস্টাইল ফলো করে অনেকে উপকৃত হলেও বাজে অভিজ্ঞতার কথাও জানিয়েছেন কেউ কেউ। মুক্ত মেহেদী নামে এক তরুণী বলেন, ‘এক বছর ধরে আমি জেকে লাইফস্টাইল ফলো করছি; কিন্তু এখন আর পারছি না। শরীর অনেক দুর্বল লাগে। প্রচুর চুল পড়ছে। আবার পেট না কমলেও হাত-পা ও ঘাড় অনেক শুকিয়ে গেছে।’

সালিম আরজু মনি নামে আরও একজন বলেন, ‘জেকে লাইফস্টাইল শুরুর তিন দিন থেকেই আমার পুরো শরীর এলার্জিতে ভরে গেছে। অনেক কষ্ট হয় হাঁটতে, ব্যায়াম করতে, রোদে গেলে; বিশেষ করে নামাজ পড়তে। দুই হাত ফুলে গেছে। এখন চুলকালে হালকা হালকা পানি বের হয়।’

এ সমস্যাগুলোকে অবশ্য জেকে লাইফস্টাইল সঠিকভাবে ফলো না করার কারণ হিসেবে দেখছেন ডা. জাহাঙ্গীর কবির, ‘আমরা ঘুমের কথা, কোয়ালিটি স্লিপের কথা বলছি, ব্যায়াম এবং অটোফেজির কথা বলছি। মূলত রোগীরা অটোফেজি করে ভালো হচ্ছে। তারা অটোফেজি ক্লিনিকাল ইউজ যদি সঠিকভাবে করতে পারে, তাহলে কোনো সমস্যা দেখা দেবে না। এটা একটি কাম্বিনেশন, প্যাকেজ। এটাকে একটা ট্যাক দিয়ে যদি সমালোচনা করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এটি ইনটেনশনালি করা হচ্ছে। আমাদের পাঁচটি কম্পোনেন্ট থাকতে হবে- সুস্থ খাবার, কোয়ালিটিফুল ঘুম, ব্যায়াম, মানসিক শান্তি ও শারীরিক চর্চা। অটোফেজির সঙ্গে যদি শারীরিক চর্চা, ভালো ঘুম, মানসিক প্রশান্তি থাকে এবং সুস্থ খাবার খাওয়া হয় তবে অসুস্থ বা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অবশ্য বলছেন, ডায়েটের পরিণতি না জেনেই শর্করা কমানোর কারণে অনেক ডায়াবেটিস রোগীই তাৎক্ষণিক উপকার পেয়ে ওষুধ বন্ধ করে দেন। এতে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর শরীরের স্বাভাবিক মেটাবলিজমে ব্যাঘাত ঘটার কারণে রোগীকে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে আইসিইউ পর্যন্ত যেতে হয়।

এ বিষয়ে মার্কিন পুষ্টিবিদ লি ক্রসবি বলেন, ‘ওজন নিয়ন্ত্রণের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি হলো দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের হিসাব রাখা। খাদ্যাভ্যাসে বিভিন্ন ধরনের খাবার থাকতে হবে। ফল, সবজি, লতা, পরিপূর্ণ শস্য, মাংস- সবকিছুই শরীরের জন্য জরুরি। তাই পরিমাণ মতো সবই খেতে হবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!