• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
মাহমুদ দারবিশের কবিতা

পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার


অনুবাদ : সাকিব জামাল  আগস্ট ২, ২০২১, ১২:০১ পিএম
পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার

ছবি : মাহমুদ দারবিশ

পরিচয়পত্র

লিখে রাখো!
আমি একজন আরব
পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার
আটটি সন্তান আছে আমার
নবম সন্তানটি জন্ম নিবে আসছে গ্রীষ্মে! 
তোমাদের কি আছে রাগ করার?

লিখে রাখো!
আমি একজন আরব 
সহকর্মীদের সাথে পাথর ভাঙার কাজ করি।
আটটি সন্তান আছে আমার 
তাদের জন্য - 
রুটি, জামাকাপড় এবং পড়াশোনার ব্যবস্থা করি
এই কাজ করেই। 
এবং তোমাদের দরজায় কোন ভিক্ষা চাই না,
দ্বারে দ্বারে পদলেহন করার স্বভাব নেই আমার।
এতে কি আছে রাগ করার?

লিখে রাখো।
আমি  একজন আরব।
আমি শিরোনাম ছাড়াই একটি নাম,
আমি একজন ধৈর্যশীল মানুষ, এমন একটি দেশের নাগরিক  
যেখানে সবাই ক্ষুব্ধ।
আমার শিকড়
জন্মের আগেই এখানে গ্রথিত 
যুগ যুগান্তর আগে,
পাইন এবং জলপাই গাছগুলোর আগে,
ঘাসগুলো ছড়িয়ে পরারও আগে।
আমার বাবা একটি লাঙলের পরিবার থেকে এসেছেন 
উচ্চবংশ, আভিজাত্য পরিবার থেকে নয়।
এবং আমার দাদা একজন কৃষক ছিল
হয়তো লিপিবদ্ধ নেই গোত্র কিংবা বংশ পরিচয়।
সূর্যের মতো গর্ব করতে শিখিয়েছেন আমাকে
এমনকি কোন পড়াশুনা শুরু করার আগেই!
আমার বাড়ি একজন প্রহরীর ঝুপড়ির মতো
বেত ও কঞ্চির তৈরি।
আমার অবস্থা তোমাদের সন্তুষ্ট করে কি?
আমি শিরোনাম ছাড়াই একটি নাম...

লিখে রাখো।
আমি একজন আরব।
চুলের রঙ মিশকালো।
বাদামী রঙ চোখগুলো।
আমার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য-
আমার মাথায় আরবের ঐতিহ্যময় পাগড়ি
স্পর্শ করলে আঁচড় লাগতে পারে!
আমার ঠিকানা-
এক প্রত্যন্ত গ্রাম, যা এখন নিশ্চিহ্ন,
নাম ছাড়া যার রাস্তাগুলো,
এবং এর সমস্ত লোক এখন মাঠে বা অন্যগ্রামে বাস করে।
কি আছে রাগ করার এ নিয়ে?

লিখে রাখো।
আমি একজন আরব।
তোমরা আমার পিতৃপুরুষদের আঙ্গুরক্ষেত চুরি করেছ
যে জমিতে আমি এবং আমার সন্তানেরা চাষাবাদ করতাম,
তোমরা আমাদের এবং আমার অনুজ প্রজন্মের জন্য রেখে গেছ 
কেবলমাত্র এই পাথরগুলো।
তাও কি কেড়ে নেবে তোমাদের সরকার?
যেমনটি বলা হচ্ছে বারবার?

সুতরাং
প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষে লিখে রাখো-
আমি মানুষকে ঘৃণা করি না,
কারও সম্পত্তি আমি কেড়ে নিচ্ছি না।
তবে যদি আমি ক্ষুধার্ত হয়ে যাই
দখলদারদের মাংসই হবে আমার খাবার।
সাবধান, 
সাবধান,
আমার ক্ষুধা 
এবং আমার রাগ থেকে সাবধান!

জেরুজালেম

জেরুজালেম, প্রাচীন দেয়াল থেকে দেয়ালে আনমনে এক যুগ থেকে অন্য যুগে ছুটে চলি কোন প্রকার স্মৃতির সাহায্য ছাড়া! এখানে নবীগণ রেখে গেছেন পবিত্র ইতিহাস ... স্বর্গে আরোহণ করেছেন এবং ফিরেছেন কম হতাশা ও অস্বস্তি নিয়ে, 
কারণ, ভালবাসা এবং শান্তি পবিত্র। এ শহরে আছে তারই ছোঁয়া।
আমি একটি ঢাল বরাবর হাঁটছিলাম এবং নিজে নিজে ভাবছিলাম: 
বর্ণনাকারীরা পাথরের মতো ভারি কিন্তু সরল কথাগুলো নিয়ে কীভাবে দ্বিমত পোষণ করেন?
এটি কি একটি ম্লান আলো যা জ্বলন্ত পাথর থেকে যুদ্ধের দামামা বাজায়?
আমি ঘুমের মাঝে হাঁটি। আমি ঘুমের মাঝে তাকাই। দেখি, আমার পিছনে ও সামনে কেউ নাই।
সমস্ত আলো আমার জন্য। আমি হাঁটি, তারপর হালকা হয়ে উঠি, উড়ে বেড়াই, এক অন্য আমি হয়ে যাই। রূপান্তরিত আমি। ভেসে আসে যেন ঘাসের মতো ফুটন্ত মুখ থেকে নবী ঈসার বাণী- ‘যদি তুমি বিশ্বাস না করো তবে তুমি অনিরাপদ।’
আমি হাঁটতে থাকি যেন আমি অন্যকেউ। এবং আমার ক্ষত উজ্জ্বল সাদা গোলাপ হয়ে ওঠে আর আমার হাত দু’টি কবুতরের মতো, কোনাকুনি হয়ে পৃথিবীর ভার বহন করে।
তখন আমি না-হেঁটে, উড়ে চলি, অন্যরূপে, রূপান্তরিত আমি। কোন জায়গা এবং সময় নির্দিষ্ট নেই আমার জন্য। তাহলে আমি কে?
আগের আমি নেই, অনাকাঙিক্ষত উপস্থিতি মাত্র। কিন্তু আমি নিজেকে ভাবতে থাকি- একা। নবী মুহাম্মদ (সা:) যেমন পবিত্র আরবি ভাষায় কথা বলতেন, আমি তেমনই কথা বলি। ‘এবং তারপর কি?’
তারপর কি? একজন মহিলা সৈনিক চিৎকার করে ওঠে- আবার তুমি? আমি কি তোমাকে হত্যা করিনি?
আমি বলেছিলাম- তুমি আমাকে হত্যা করেছ ...
কিন্তু আমিও ভুলে গেছি তোমার মতো মারা যেতে, আমি মৃত্যুহীন, ফিরে ফিরে আসি!

আমাদের দেশ

আমাদের দেশ,
স্রষ্টার বাণীর মতোই কাছাকাছি,
যেন মেঘের ভেলা 
আমাদের দেশ,
এটি বিশেষ্যগুলি থেকে একটু দূরে, বিশেষণ।
অনুপস্থিত মানচিত্র
আমাদের দেশ,
এটি তিলের বীজের মতো ক্ষুদ্র
এক স্বর্গীয় দিগন্ত ... এবং একটি লুকানো গহ্বর
আমাদের দেশ,
এবং এটি গরিব যেন গ্রাউসের ডানা
পবিত্র বই ... এবং এক পরিচয়হীন ক্ষত
আমাদের দেশ,
এটি চারিদিকে বিচ্ছিন্ন পাহাড়ে ঘেরা,
যেখানে লুকানো নতুন অতীত
আমাদের দেশ একটি যুদ্ধের উপহার,
জ্বলন্ত ও ভীষণ আকুলতা থেকে মৃত্যুর স্বাধীনতা
এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের রাতে আমাদের দেশ
একটি রত্নের মতো যা বহুদূর থেকে উজ্জ্বল দেখা যায়
এবং এর বাইরে যা আছে তা আলোকিত করে...
কিন্তু ভিতরে, আমাদের অবস্থা,
ক্রমাগত দম বন্ধ হয়ে যাই আমরা!


মাহমুদ দারবিশ (১৩ই মার্চ ১৯৪১ - ৯ই আগস্ট ২০০৮) ছিলেন ফিলিস্তিনদের জাতীয় কবি।
দারবিশ ফিলিস্তিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মাঠে ছিলেন সবসময়। তবে তিনি লড়েছেন কবিতা দিয়ে।

সোনালীনিউজ/এসএন

Wordbridge School
Link copied!