• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

বাঙালির অন্তিম আইকন


গৌতম গুহ রায় অক্টোবর ১০, ২০২১, ০১:৩৯ পিএম
বাঙালির অন্তিম আইকন

‘কবি যেদিন মৃত্যুর সাঁকোটা পেরিয়ে যায়

জন্মের দিন থেকে জমে ওঠা

সব ঋণের বোঝা

সেদিন ছাই হয়ে যায়’

বছর পাঁচেক আগে লিখেছিলেন, ৪০ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে অবশেষে জন্মের দিন থেকে জমে ওঠা সব ঋণের বোঝা ছাই করে চলে গেলেন তিনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলার সাংস্কৃতিক সামাজিক আকাশের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। অভিনয় তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতি আনলেও এই আগাগোড়া বাঙালি মানুষটি অন্তর্গঠনে ছিলেন পুরোদস্তুর কবি। যৌবনে তাঁর পরিমণ্ডল ছিলো কবিতা ও লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে, সম্পাদনা করেছেন ‘এক্ষণ’-এর মতো একটি অগ্রগণ্য লিটল ম্যাগাজিনের। বছর কুড়ি আগে খুব অসময়ে চলে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী নন্দিনী মালিয়া, এই মৃত্যু তাঁকে ঘুমোতে দেয় নি, মধ্যরাতে একটি কবিতা লিখেছিলেন, তার কটি লাইন ছিলো এমন, ‘উদ্দেশ্য ঘর, তবু নিরুদ্দেশ কিছু কিছু লোক/যে যাবার সে তো সত্যিই চলে গেল...।” আজ এই অতিমারী আক্রান্ত বিশ্বের সেই কবি, সেই অভিনেতা সত্যিই চলে গেলেন, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিকে নিঃস্ব করে দিয়ে।

কলকাতার গলফ গ্রিনের ফেজ সিক্সের ৯ নম্বর বাড়িটি থেকে কোভিড পজিটিভ সৌমিত্রকে যখন চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয় তার দুদিন আগেও তিনি থিয়েটারের মহরা দিয়েছিলেন, নতুন নাটকের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। চলচ্চিত্র তাঁর মুখ্য পরিচিতি, আন্তর্জাতিক পরিচয় দিলেও তাঁর ব্যক্তিগত আরামের যায়গা ছিলো থিয়েটার। শিশির ভাদুরী ছিলেন তাঁর অভিনয় জীবনের গুরুদেব। প্রয়াণের পরদিন সৌমিত্রশূন্য সেই ঘরে দাঁড়িয়ে সৌমিত্রকন্যা পৌলমী বলছিলেন, ‘বাপি তো চুপচাপ বসে থাকার মানুষ ছিলেন না। হয় পড়ছেন, না হয় লিখছেন কিংবা ছবি আঁকছেন। অভিনয় বাপির সবচেয়ে প্রিয়, কিন্তু সেটাই তো সব নয়। শিল্পের সব কিছুকে ছুঁতে চাইত।’ সত্যিই তা-ই, আমৃত্যু কাজের মধ্যেই ছিলেন। ৮৫ একজন মানুষের পক্ষে পূর্ণ জীবন বলা যায়, কিন্তু নানামুখী বিকশিত প্রতিভার এই উজ্জ্বল মানুষটির ক্ষেত্রে তা বলা যায় না, এই বয়সেও যে অসম্ভব পরিশ্রম ও কাজের মধ্যে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন যা একজন গড়পড়তা মানুষের কাছে অকল্পনীয়। শেষ কদিন কাজ করছিলেন নিজের কন্যার করা একটি ডকুমেন্টারিতে, ‘নাম সৌমিত্র’। কদিন আগেও রবীন্দ্র সদনে শুটিং করেন তাঁরা। টানা দুদিন পাঠ করলেন সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’। ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওতে শুটিং করলেন। এটাই শেষ। মেয়ে পৌলমী বসুর কথায়, ‘পরের দিন সামান্য অসুস্থ হলো। বলল, একটু রেস্ট নিতে চায়। উইক ফিল করছে। পরের দিন, মানে ২ অক্টোবর, জ্বর এলো। তখনও আমরা ভাবতে পারিনি করোনা হতে পারে বাপির। টেস্ট করানো হলো দুদিনের মধ্যে। ৫ তারিখে রিপোর্ট এলো, ‘পজিটিভ’। পরের দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।... আমি, মা, দাদা, বাবার ছায়াসঙ্গী সমরেশ সবাই ‘নেগেটিভ’। এমনকি রবীন্দ্র সদনে আমাদের টিমের যারা শুট করেছিলেন, তাঁরাও দেখা গেল, প্রত্যেকে নেগেটিভ। এমনই দুর্ভাগ্য আমাদের যে, একা বাপিরই কোভিড ধরা পড়লো!’

প্রথম জীবনে কবিতা, লিটল ম্যাগাজিন, তারপর থিয়েটার, ফিল্মে অভিনয়েও অতৃপ্ত শিল্পী অবশেষে সমপ্রতি ছবি আঁকায় মজেছিলেন। লকডাউনের সময় জলরংয়ে ছবি আঁকাতেন। সৌমিত্রশূন্য ঘরে তাঁর আঁকা কয়েকটি অসম্পূর্ণ ছবি পড়ে থাকলো, আর থাকলো উত্তরের দেওয়ালে বিরাট একটি প্রতিকৃতি, তাঁর গুরুদেব নাট্যাচার্য শিশির ভাদুরীর। প্রতিদিন কাজে বেরুনোর সময় যাকে দেখে তিনি বেরুতেন! চার দশক আগে চলে গেছেন উত্তম কুমার, তর্কপ্রবণ বাঙালি যার সঙ্গে তার তুলনায় মজে থাকে আজও। কিন্তু বহুমুখী বিচ্ছুরণে সৌমিত্র অনন্য। পৃথিবীর একমাত্র চলচ্চিত্র অভিনেতা যার প্রায় হাজার পাতার কবিতার বই আছে, যার তিন খণ্ডের বিপুলাকারের নাট্যসংগ্রহ আছে, অগুনতি বিষয় নিয়ে লেখা প্রবন্ধ আছে, সংকলন গ্রন্থ আছে। ফিল্মের বাইরেও কত শিল্পপ্রবাহে নিজেকে মেলে ধরেছেন তিনি, সে পর্যালোচনা বাঙালি চিরদিন করবে, যতদিন বাংলার সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে। কবি, আবৃত্তিকার, নাট্যকার, নাট্যভিনেতা, নির্দেশক, শিক্ষক, সম্পাদক, কত কত বহুমুখী প্রকাশ ছিলো বাঙালির এই আইকনের। উৎপল দত্ত ছিলেন তাঁর সম-আদর্শের মানুষ, তাঁর অগ্রজ সহযোদ্ধা। সেই উৎপল দত্ত তিন দশক আগে চলে গেছেন। সেই উৎপল দত্তের মৃত্যুর পর সৌমিত্র লিখেছিলেন, ‘জীবনে উৎসবের দিন, লগ্ন ইত্যাদির নির্বাচন সম্ভব, কিন্তু অনিবার্য আঘাতের নয়।’ সেদিন একটি নাটকের ২০০তম রজনীতে নামার কথা ছিলো দুজনের, কিন্তু উৎপল দত্তের হঠাৎ প্রয়াণ সবকিছু ভেস্তে দেয়। তাঁর অভিনয় জীবনের ঈশ্বর ছিলেন শিশির ভাদুরী। শিশির ভাদুরী প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে প্রথম স্বাভাবিক ভাবে অভিনয়ের শিক্ষা তিনি তাঁর কাছ থেকেই পান, আজীবন এই ‘স্বাভাবিক’ অভিনয় করে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। শিশির ভাদুরীকে নিয়ে তাঁর লেখায় তিনি লিখেছেন, ‘যে সময় আমি শিশির কুমারের অভিনয় দেখতে আরম্ভ করি তখন আমি সদ্যযুবক। সে সময়ে নাটক দেখার যে সামান্য অভিজ্ঞতা ছিল সেখানে থিয়েটারি বাচনরীতি ছিল প্রবল। বিশেষ করে ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক নাটকের অভিনয়ে সুরের প্রাবাল্য ছিল অবধারিত। কিন্তু শিশির কুমারের অভিনয় যেন এর ঠিক উলটো পথ ধরে চলত। স্টাইলাইজড বা হাইটেন্ড স্পিচকে সুরবর্জিত করে সাধারণ কথোপকথনের ভূমিতে অবতরণ করাতেন শিশির কুমার। এর ফলে সংলাপের অর্থ খুব সহজেই দর্শকের বোধগম্য হতো।’ এখানেই তাঁর, অর্থাৎ সৌমিত্রেরও অভিনয় স্বাতন্ত্র্য গড়ে ওঠে।

প্রত্যক্ষ রাজনীতির থেকে দূরে থাকা বাঙালির এই আইকন মানুষটি দীর্ঘকায় ও ঋজু মেরুদণ্ড নিয়ে প্রতিটি সামাজিক ঘটনায় তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করতেন। প্রত্যক্ষভাবে অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে অটল ছিলেন। অনুজ কবি শ্রীজাত তাঁর প্রয়াণে লিখেছেন যে, সত্যিকারের আইকন পেতে একটা জাতির অনেক দিন লেগে যায়। এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি আদর্শ, যিনি অনুসরণযোগ্য, যিনি নক্ষত্র, অথচ যিনি স্পর্শাতীত নন। এই সমস্ত গুণ একজন মানুষের মধ্যে দেখতে পেলে তবেই তাঁকে আইকন বলে মেনে নেওয়া, আইডল বলে স্বীকৃতি দেওয়া, না হলে নয় । জাতি হিসাবে বাঙালির বড় সৌভাগ্য যে, এমন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ব্যক্তিত্ব সে বড় কম পায়নি । কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, সেই প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য হয়ে আসছে দ্রুত। যে ভান্ডারের শেষতম উজ্জ্বলতা নিয়ে চলে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বলতে দ্বিধা নেই যে, জৌলুস আর মেধার এমন সংমিশ্রণ, তারকা ও মানুষের এমন সহাবস্থান, জনপ্রিয় ও প্রিয়জনের এমন মেলবন্ধন বাঙালি এর আগে পায়নি।’ এই সটান মেরুদণ্ড তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর দাদু স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধা ছিলেন, হাওড়া বোমা মামলায় জেল খেটেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনে বাবা জেল খেটেছেন। আমাকে এক আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, শৈশবে তাঁর খুব ইচ্ছে ছিলো সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। দেরাদুন মিলিটারি স্কুলের ফরমও আনান, কিন্তু সময় পেরিয়ে যাওয়ায় সে ফরম জমা দেওয়া হয় নি। বাবা এই কথা শুনে বলেছিলেন, ‘ভালোই হয়েছে, তুমি পারতে না। তাঁদের অফিসারদের করা স্যালুট দেখে তুমি ওভাবে স্যালুট দিতে পারতে না।’ অগ্নিযুগের বিপ্লবী বাঘাযতীন ছিলেন দেশের বাড়িতে তাদের পড়শি। অনেক দিন তাঁদের বাসায় সে আশ্রয় নিয়েছেন, আরো অনেক বিপ্লবীই আসতেন তাঁদের বাসায়। সেই পরিবারের কেউ ওভাবে কারো সামনে মাথা নোয়াতে পারতেন না।

বরেণ্য অনেকের মতোই শোক ও আঘাত তাকে বারবার বিধ্বস্ত করেছে, আবার সেই অন্ধকারকে জয় করে কালবিলম্ব না করে তিনি লড়াইতে ফিরেছেন। শেষ দিকে তাঁকে বিধ্বস্ত করেছে প্রিয় নাতির পথ দুর্ঘটনা, এখনো সে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। একদিন আলাপের ছলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, তিনি ভবিষ্যতের জন্য কোন উত্তরাধিকারি রেখে গেলেন, জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘কিচ্ছু না, আমিই অন্তিম।’ কিন্তু তাঁর সৃজন প্রতিভার প্রকাশ নাতির মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন, তাঁর অসুস্থতা তাই তাঁকে বিপর্যস্ত করেছিলো, হয়তো এই বয়সে এসে আরো কাজের মধ্যে ডুবে যাওয়ার এটিও অনুঘটকের কাজ করছিলো। শারীরিক দিক দিয়ে তিনি খুব একটা অসুস্থ না হলেও ২০০৯ সালে তাঁর এনজিওপ্লাস্টি হয়েছিলো। ডা. কুনাল সরকার তাঁর চিকিৎসক ছিলেন সে-সময়। ডা. সরকার বলছিলেন যে, সাধারণত চলচ্চিত্রের নায়ক মানেই প্রচণ্ড এরোগেন্ট হয়ে থাকেন, একতা ঔধ্যত্বের আবরণ তাকে ঘিরে রাখে। কিন্তু সৌমিত্রবাবুই দেখালেন নায়ক কত সাবলীল। সত্যজিতের ১৪টি সিনেমার নায়ক কী শিক্ষিত, মার্জিত বিনয়ী। এটা নিয়ে আমি ওঁকে একদিন জিজ্ঞেস করেছি, স্মিত হেসেছিলেন। তারকাদের যে একতা বলয় ঘিরে থেকে সৌমিত্রের সেই বলয় ছিলো না, সবাই তাঁকে ছুঁতে পারতেন, কাছে গিয়ে কথা বলতে পারতেন। কবিতা নিয়ে, গান নিয়ে কথা বলতে পারতেন, এটাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মতাদর্শে আজীবন বামপন্থী ছিলেন, কিন্তু উগ্র বামপন্থা তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি। নিজেকে না বিক্রি করে যে টিকে থাকা যায় তা তিনি দেখিয়েছিলেন। মানুষের বিপন্নতায় পাশে দাঁড়িয়েছেন অকুতোভয়ে, সাম্প্রদায়িক হানাহানির সময় প্রতিবাদে পথে নেমেছেন, ষাটের খাদ্য আন্দোলনে ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে থেকে পথে নেমেছেন, সম্প্রতি ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে পথে নেমেছেন, ক্রান্তিকালে ঠিক জায়গায় ক্রোধ স্থাপনের বার্তা দিয়েছেন। এই হলেন সৌমিত্র, বাঙালির বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক নকশিকাঁথার শেষ আইকন।

লেখক : কবি ও সাহিত্য সমালোচক

Wordbridge School
Link copied!