ঢাকা: রাজশাহীর খড়খড়ি বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে, পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় গ্রামে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। ঋণে জর্জরিত ও অভাব-অনটনে জর্জর দিনমজুর মিনারুল ইসলাম নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন।
একসময় জুয়া ও মাদকে আসক্ত ছিলেন মিনারুল। পরবর্তীতে ভুল বুঝতে পেরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করলেও ঋণের চক্র থেকে মুক্ত হতে পারেননি তিনি।
জানা গেছে, গ্রামের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষই বিভিন্ন এনজিও ও সুদের কারবারিদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে নেশা ও জুয়ার ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছেন।
বামনশিকড় একটি প্রত্যন্ত গ্রাম, যেখানে আড়াইশ পরিবার বসবাস করে। অধিকাংশ বাসিন্দা দিনমজুর, রিকশাচালক বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। শিক্ষার হার কম হওয়ায় জীবিকা উন্নতির আশায় অনেকেই এনজিওর ঋণের ওপর নির্ভর করেন। টিএমএসএস, আশা, ব্র্যাক, কারিতাস, শাপলা গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা ও শতফুলসহ একাধিক এনজিও এখানে সক্রিয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব এনজিওর কর্মীরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে ঋণ দেন এবং সময়মতো কিস্তি পরিশোধ না করলে চাপ প্রয়োগ করেন। এতে অনেকে এক এনজিওর ঋণ শোধ করতে গিয়ে আরেকটির ঋণ নেন, যা শেষ পর্যন্ত এক অদৃশ্য ঘূর্ণাবর্তে পরিণত হয়। এর জেরেই ইতোমধ্যে কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় একজন বলেন, ‘মাদক আর কার্ড খেলাই গ্রামের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। যুবক থেকে মধ্যবয়সী প্রায় সবাই নেশায় আসক্ত। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে এনজিওর ঋণে ডুবে যায়, পরে কিস্তি দিতে না পেরে জীবনের চাকা থেমে যায়।’
অন্যদিকে গ্রামের এক নারী জানান, তার স্বামী দিনে প্রায় ২০০ টাকা নেশায় খরচ করেন, অথচ আয় সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। ফলে সংসার বা ঋণ—কোনোটাই ঠিকভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তার অভিযোগ, ‘৫ আগস্টের পর গ্রামে নেশা ও জুয়ার প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে।’
স্থানীয় এক ঋণগ্রহীতা জানান, ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিলে সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে হয় ১ হাজার ৩০০ টাকা, যা ৪৬ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয়। মাসিক কিস্তির পদ্ধতিতে দিতে হয় মাসে ১০ হাজার টাকা।
গ্রামের আরেক নারী জানান, ‘পরিশোধের ক্ষমতা আছে কি না, সেটা এনজিওরা খতিয়ে দেখে না। ফলে অনেকেই ঋণ নিয়ে জুয়া বা নেশায় টাকা উড়িয়ে দেন। পরে কিস্তির চাপ এলে আরেক এনজিও থেকে ঋণ নেন। ফলে ঋণের বোঝা থেকে আর বের হওয়া যায় না। এমনকি এনজিও কর্মীরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাদের তাড়া করে ফেরেন।’
মিনারুলের প্রতিবেশী রিকশাচালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে তিনি আমাদের সঙ্গে বসেছিলেন। সেদিন সারাদিনই টাকা জোগাড়ের জন্য ছোটাছুটি করেছেন। রাতে বাবাকে ফোন করে বলেন, ‘আমার জন্য আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। আমার জন্য আর কোনো চেষ্টা করবেন না। আমি খুব ঋণের মধ্যে আছি, আমাকে মাফ করে দিন।’
রাকিবুল আরও জানান, মিনারুল প্রায়ই বলতেন জীবন শেষ করে দেবেন, তবে হঠাৎ এমন ঘটনা ঘটবে তা কেউ কল্পনাও করেনি।
টিএমএসএস খড়খড়ি শাখার ম্যানেজার মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘মিনারুল আমাদের কাছ থেকে এক বছর আগে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। নিয়মিত কিস্তি দিতেন। শেষদিকে মাত্র দুই হাজার ২০০ টাকা বাকি ছিল। অসুস্থ মেয়ের কারণে আমরা তাকে আর চাপ দিইনি। পরে হঠাৎ তার মৃত্যুর খবর পাই।’
পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মোর্শেদ বলেন, ‘আগে জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করলেও ছোট মেয়ের অসুস্থতার কারণে মিনারুল আবারও ঋণের মধ্যে পড়ে। এছাড়া এলাকায় মাদক ও জুয়ার বিস্তার ঘটেছে। এ থেকে মানুষকে ফেরাতে শিগগিরই সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মতিহার থানার ওসি আব্দুল মালেক জানান, প্রাথমিক তদন্তে ধারদেনা ও হতাশাজনিত কারণে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মিনারুলের ছোট মেয়ে প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ ছিল। চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তিনি লাঞ্ছনার শিকার হন।
ওএফ
আপনার মতামত লিখুন :