২১ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি মোনাজাতের মৃত্যু তদন্ত

  • রংপুর প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬, ০২:৩৬ পিএম
২১ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি মোনাজাতের মৃত্যু তদন্ত

রংপুর : দীর্ঘ একুশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের মৃত্যুর তদন্ত রিপোর্ট। খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো কুল-কিনারা। উদঘাটন হয়নি মৃত্যুর কারণ। ‘যা রটে তার কিছুটা বটে’ এমন মুখরোচক কথাতেই সীমাবদ্ধ থেকে আরও একটি বছর চলে গেল। শুধু এটুকুই সান্তনা যে, খবরের খোঁজে বের হয়ে নিজেই খবর হয়ে ফিরে এসেছিলেন তিনি। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো খবরের বাস্তবতার ছবি ক্যামেরা বন্দি হবার আগেই পা পিছলে ফেরী থেকে নদীতে পড়ে সবার কাছ থেকে চিরদিনের ছুটি নিয়ে ওপারে চলে যায় সে। সেদিন জীবন্ত মোনাজাতের তোলা ছবি নয়, বরং লাশ হয়ে ফেরা মোনাজাতের ছবিই হয়েছিলো খবরের শিরোনাম।

অকালে ঝড়ে পড়া সেই মোনাজাত উদ্দিনের মৃত্যুর সঠিক তদন্তের কূল কিনারা মেলেনি আজও। জানা যায়নি কিভাবে তার মৃত্যু হলো। মৃত্যুর নেপথ্যে কোনো ষড়যন্ত্র নাকি কেউ জড়িয়ে আছে তার অকাল মৃত্যুর রহস্যে, এমন প্রশ্নের উত্তর আর কত বছরের তদন্ত রিপোর্টে জাতি জানবে তাই এখন দেখার অপেক্ষা।

বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের একুশতম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৫ সালের আজকের এই দিনে সংবাদ সংগ্রহের জন্যে ছুটে গিয়েছিলো গাইবান্ধায়। সেখানে ফুলছড়ি উপজেলার যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্ট থেকে ফেরী যোগে নদী পারাপারের সময় পা পিছলে নদী গর্ভে হারিয়ে যায় মোনাজাত উদ্দিন। অকালেই মৃত্যুর সাথে দেখা হয় তার।

ঘটনার একদিন পর ৩০ ডিসেম্বর মুন্সিপাড়া কবরস্থানে চিরদিনের জন্য শায়িত হয় মোনাজাতের মরদেহ। সেদিন চির বিদায়ের সাথে প্রশ্ন রেখে যায় সবার মাঝে। সত্যি কি পা পিছলে পড়ে নাকি কোনো ষড়যন্ত্রে পড়ে চলে গেলাম। সেই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তৎকালীন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর পর একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিলো। সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গেল একুশ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। আর কত বছর পর উদঘাটিত হবে তার মৃত্যু রহস্য, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে গোটা জাতিসহ সাংবাদিক সমাজকে।

রংপুরের কৃতিসন্তান মফস্বল সাংবাদিকার দিকপাল চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন একজন সফল গবেষকও ছিলেন। তার লেখনিতে ওঠেছে এসেছিলো গ্রাম-বাংলার অজানা অনেক কথা। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এরপর তথ্য-উপাত্তের সঠিক কিনারা উপলব্ধি থেকেই কলমের কালি দিয়ে তৈরি হতো মোনাজাতের রিপোর্টিং। সততা, ধৈর্য্য আর অসীম সাহসিকতাকে পুঁজি করেই তিনি সাংবাদিকতায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। যার কারণে তার লেখনিতে পাঠকরা ছিলো সব সময় জাগরিত সমাজের একাংশ।

ছাত্র থাকা অবস্থাতেই বগুড়ার সাপ্তাহিক বুলেটিন পত্রিকার মাধ্যমে জুঁকে পড়ে সাংবাদিকতায়। ১৯৬২ সালে স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে ঢাকার কাগজ দৈনিক আওয়াজ এবং ১৯৬৬ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

স্বাধীনতার পর তিনি নিজেই দৈনিক রংপুর নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আর্থিক সমস্যার কারণে সেটি থমকে যায়। এরপর ১৯৭৬ সাল থেকে মোনাজাত উদ্দিন দৈনিক সংবাদে প্রায় ২০ বছর কাজ করেন। সেখান থেকে বের হয়ে ১৯৯৫ সালে দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় তিনি সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেয়। মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত জনকন্ঠই ছিলো তার ঠিকানা।

মোনাজাত উদ্দিন শুধু সাংবাদিকতায় ব্যস্ত ছিলেন না। ব্যস্ততা ছিলেন নাটক, গল্প, কবিতা আর ছড়া লেখায়ও। বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘করিম মন্ডলের বৈঠকখানা’র পান্ডলিপি লেখার পাশাপাশি ভালো গীতিকার হিসেবেও তার ছিলো বেশ সুনাম। মৃত্যুর আগে তার লেখা নয়টি এবং পরে আরো দুটি গ্রন্থ প্রকাশ পায়। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে - পথ থেকে পথে, মজিবর ও শাহ আলমের কাহিনী, কানসোনার মুখ, লক্ষীটারী, অনুসন্ধানী রিপোর্ট ইত্যাদি।

উত্তরের অহংকার চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৭ সালে ফিলিপস পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে (মরণোত্তর) ২১শে পদকসহ প্রায় অর্ধ ডজন পুরস্কার পান।  

মফস্বল সাংবাদিকতায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা দেশ বরেন্য এই সাংবাদিকের জন্ম হয়েছিলো ভাওয়াইয়ার সুরে ভরা বাহের দেশখ্যাত রংপুরের উর্বর ভূমিতে।  নগরীর ধাপ এলাকায় ১৯৪৯ সালের ১৮ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা মৌলভী আলিম উদ্দিন আহমেদ ও মাতা মতিজানেছার আদরের মোনাজাত কৈলাশ রঞ্জন স্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ শেষে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এসময় তার বাবাকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে মোনাজাত উদ্দিন। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করেন তিনি।

অনেক পথ থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সত্যের পথে। সেখান থেকেই সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে সমাজে সত্যের আলো তুলে ধরেছেন। এখনো অনেক জীবন্ত মোনাজাত উদ্দিনের বিচরণ রয়েছে আমাদের মাঝে। কিন্তু কেউ পারেনি মৃত মোনাজাত উদ্দিনের মৃত্যুর তদন্তে আলো দেখাতে। তার মতো অনেক সাংবাদিককে আমরা হারিয়েছে কারণে অকারণে। নৈপথ্যে রয়েছে কি কারণ, না অকারণ তার তদন্ত আজো চলছে... চলবে...চলবে। এভাবেই হয়তো আরো অনেক মোনাজাত উদ্দিন, সাগর-রুনি, আফতাব আহমেদ, উৎস রহমান, আওরঙ্গজেব সজীবের মতো আরও অনেকেই হারিয়ে যাবে তদন্তের আলো দেখার আগেই।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Link copied!