লংগদুতে যুবলীগ নেতা হত্যা

পাহাড়িদের শত ঘরে আগুন

  • রাঙামাটি প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ৩, ২০১৭, ০৯:৪৪ এএম
পাহাড়িদের শত ঘরে আগুন

রাঙ্গামাটি: জেলার লংগদুতে যুবলীগ নেতা ও মোটরবাইক চালক নুরুল ইসলাম নয়ন হত্যার ঘটনায় বিক্ষুব্দ লোকজন লংগদু সদর, মানিকজোড় ছড়া, কাঁঠালতলী ও তিনটিলা গ্রামে চাকমা নৃগোষ্ঠীর প্রায় একশ’ ঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

অগ্নিসংযোগের পর ওইসব ঘরে অবস্থানরত বাসিন্দারা নিরাপদে বের হয়ে অন্যত্র অবস্থান নিয়েছে। ঘটনার পরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে লংগদু উপজেলাস প্রশাসন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করেছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক না পর্যন্ত এ নির্দেশনা বলবৎ থাকবে। শুক্রবার (২ জুন) সকাল ১০ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এরপর নিহত যুবলীগ নেতা নয়নের লাশ জানাজার জন্য বাইট্টাপাড়া থেকে লংগদু সদর উপজেলা বাজার এলাকায় নেয়ার পথে দুষ্কৃতিকারীরা পাহাড়িদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়।

ঘটনার পরপর পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। সেখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার লংগদু উপজেলা থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন দুইজন যাত্রী নিয়ে দীঘিনালার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু দুপুরের পর দীঘিনালার চারমাইল এলাকায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়।

পরে সন্ধ্যায় ফেসবুকে তার মৃতদেহের ছবি দেখে সনাক্ত করে পরিবার ও বন্ধুরা। শুক্রবার সকালে নয়নের লাশ লংগদুতে তার গ্রামের বাড়ি বাইট্টাপাড়া আনা হয়। সেখান থেকে লংগদু বাসীর ব্যানারে প্রায় আট হাজার বাঙালির একটি বিশাল শোক মিছিল উপজেলা সদরের দিকে যাচ্ছিলো জানাজার উদ্দেশ্যে।

হঠাৎ একই উপজেলার ঝর্ণাটিলা এলাকায় মারফত আলী নামের এক বাঙালির বাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে দুষ্কৃতিকারীরা প্রধান সড়কের পাশের লংগদু উপজেলা জনসংহতি সমিতির কার্যালয়সহ আশেপাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করা শুরু হয়।

আগের দিন রাতেই স্থানীয় পাহাড়িরা সম্ভাব্য গোলযোগের আশংকায় বাড়িঘর থেকে সড়ে পড়ায় কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও পাহাড়ি অধ্যুষিত তিনটিলা পাড়ার ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করা হয়। হাজার হাজার দুষ্কৃতিকারীর সামনে লঙগদু থানার ৫০ জন পুলিশ সেখানে ছিল অসহায়।

পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে লংগদু সেনাজোন থেকে বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য মোতায়েন হলে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।

পরে উপজেলা পরিষদ মাঠে নয়নের জানাজা ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। শোকসভায় বক্তব্য দেন- উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাজ্জ্বল হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন, জেলা পরিষদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানে আলম, পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, সমঅধিকার নেতা অ্যাডভোকেট আবছার আলী।

বক্তব্য কালে সেনাবাহিনীর লংগদু জোন কমান্ডার লে: কর্নেল আ: আলীম চৌধুরী ও লংগদু থানার অফিসার মোমিনুল ইসলাম সবাইকে শান্ত থাকার আহবান জানান এবং নয়নের খুনিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেন।

লংগদু উপজেলা সমঅধিকার আন্দোলনের সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন, আমরা লংগদুবাসির ব্যানারে সর্বদলীয়ভাবে জানাজার জন্য উপজেলা সদরের মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর আসে ঝর্ণাটিলায় একটি বাঙালী বাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর আসে। এরপরই ঘটনা নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।

তিনটিলা এলাকার বাসিন্দা ও উপজেলা জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিশংকর চাকমা জানিয়েছেন, আমাদের পাড়ার একটি ঘরও অবশিষ্ট নেই। প্রায় দুইশতাধিক বাড়িঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে এই তিনটিলা এলাকায় তৎকালিন উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এরপর বিক্ষুদ্ধরা এই পাড়ায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করেন এবং ওই এলাকার পাহাড়ীরা দীর্ঘদিন ভারতে উদ্বাস্তু হিসেবে ছিলেন এবং ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর দেশে ফেরত আসেন।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান জানিয়েছেন, ‘আমি বিষয়টি জানার সাথে সাথেই লংগদু উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছি। আইনশৃংখলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে এবং আইনশৃংখলাবাহিনী সর্বোচ্ছ সতর্কবস্থায় আছে।’

ঘটনার পর দুপুরে লংগদু উপজেলা সদর এলাকায় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সেনাবাহিনীর লংগদু জোন কমান্ডার লে.কর্নেল আ: আলীম চৌধুরী, রাঙামাটির ডিডিএলজি প্রকাশ কান্তি, লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন, লংগদু উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(বিশেষ শাখা) সাফিউল সারোয়ার, আদ্রকছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি, লংগদু ইউপি চেয়ারম্যান কুলীন মিত্র আদু ও লংগদু থানার ওসি মমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের সহবস্থান নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থদের একটি তালিকা করে তাদের দ্রুত ক্ষতিপূরুণ নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এদিকে যুবলীগ নেতা নয়নকে হত্যার প্রতিবাদে রাঙামাটি জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ এবং পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ। দুপুরে শহরের বনরূপা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিন করে বনরূপায় এসে সমাবেশ করে।

জেলা যুবলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সম্পাদক নুর মোহাম্মদ কাজলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ছাওয়াল উদ্দিন, পৌর যুবলীগের সভাপতি আবুল খায়ের, জেলা মৎসজীবি লীগের সভাপতি উদয়ন বড়ুয়া, কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক উদয় শংকর চাকমা।

সমাবেশ থেকে অবিলম্বে পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করার আহবান জানানো হয়। দ্রুত নয়নের হত্যাকারিদের গ্রেফতারের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহবান জানানো হয়, অন্যথায় কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে বলে জানানো হয়।

একই ঘটনার প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ মিছিল  ও সমাবেশ করেছে পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ। শহরের কাঠালতলি থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বনরূপায় সমাবেশ করে। জেলা সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সভাপতি হাবিবুর রহমান, পার্বত্য নাগরিক পরিষদের আহবায়ক নূরজাহান বেগম, তুহিন প্রমুখ।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Link copied!