ঢাকা: জুলাই অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ভিন্ন বাস্তবতায় বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় শীর্ষক ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য বাজেট প্রস্তাবনা করা হয়েছে।
এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বাজেট প্রস্তাবনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন বিজিএমইএ এর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন।
৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটেলক্ষ্য বিলাষী ধারণা থেকে সরে এসে সামগ্রিক উন্নয়ন, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তোরণ প্রভৃতির উপর জোর দেয়া হয়েছে। বিজিএমইএ মনে করে, এগুলো বাজেটের অনন্য দিক।
বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫% এ নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে পোশাক কর্মীসহ দেশের স্বল্প আয়ের মানুষরা উপকৃত হবেন। সামাজিক নিরাপত্তাখাতের আওতায় কিছু কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমানোর লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সার্বিক ব্যয় ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। আগামীতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিদ্যুতের দামনা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ও নেয়া হয়েছে। এটি শিল্পের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ।
এলএনজি এর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রেট্রোলিয়াম ও ডিজেলের আমদানি শুল্কও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়েছে। আমরা মনে করি, ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল পৌঁছাবে এবং প্রত্যক্ষভাবে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমবে। সর্বোপরি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ১২৫ কোটি টাকার তহবিল গঠন, ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য গবেষনা বাবদ ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের ঘোষনা দেয়া হয়েছে। বিজিএমইএ এগুলোকে স্বাগত জানায়।
এবারের বাজেট পোশাক শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রত্যাশাপূর্ণ। কারণ বর্তমানে বিভিন্ন স্থানীয়ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, উচ্চ ব্যাংকসুদ, মজুরি বৃদ্ধি এবং গ্যাসও বিদ্যুতের ঘনঘন মূল্য বৃদ্ধির চাপে শিল্পটি পিষ্ট।
আবার অন্যদিকে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি (স্বল্পোন্নতদেশ) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হচ্ছে। এতে করে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে রপ্তানিতে ৮৪% অবদান রাখা পোশাক শিল্প। এ প্রেক্ষিতে বর্তমানে শিল্পের বিরাজমান সমস্যাগুলো মোকাবেলা এবং গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখার বিজিএমইএ এর পক্ষ থেকে বেশ কিছু বাজেট প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।
ঘোষিত বাজেটে রপ্তানির বিপরীতে উৎসে কর এবং শিল্পে করপোরেট কর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বিজিএমইএ একে সাধুবাদ জানায়।
বিজিএমইএ এর অনুরোধে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া এবং বন্ড ব্যবস্থাকে সহজীকরণ ও ব্যবসাবান্ধব করার উদ্দেশ্যে নিম্নোল্লেখিত সংশোধনীগুলো আনা হয়েছে যা তৈরি পোশাক রপ্তানি বাণিজ্যকে আরো গতিশীল করবে:
• মালিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে RJSC বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা কর্তৃক অনুমোদনের অনধিক ০২ মাসের মধ্যে বন্ড কমিশনারেটে আবেদন দাখিল করতে উল্লেখ করা হয়েছে;
• বিগত ০৩ বছরের মধ্যে ০২ বছর এর নিরীক্ষা সম্পন্ন থাকলে ০৩ বছর মেয়াদি জেনারেল বন্ড নবায়ন করা যাবে;
• এফওসি ভিত্তিতে রিভলভিং পদ্ধতিতে কাঁচামাল আমদানির কার্যক্রম সহজীকরণে কিছু শর্ত বাদ ও সংশোধন করা হয়েছে।
• এ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের পরিবর্তে রাজস্ব কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা জরিপের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে;
• ন্যায় নির্ণয়, শুল্কায়ন, গোয়েন্দা কার্যক্রমসহ নানাবিধ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কমিশনার অব কাস্টমস এর উপর অর্পিত দায়িত্ব তার স্বীয় অধিক্ষেত্রে অন্য যে কোন কাস্টমস কর্মকর্তার উপর অর্পণ করতে পারবে মর্মে আইন সংশোধন করা হয়েছে;
• আমদানিকৃত চালানের পণ্য মূল্য ২ (দুই) হাজার টাকার পরিবর্তে ৪ (চার) হাজার টাকা পর্যন্ত হলে তার বিপরীতে কোন শুল্ককর আরোপ বা আদায় করা হবে না;
• কার্গো ঘোষণা বা IGM দাখিলে ভুল হলে ন্যূনতম ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার কিন্তু অনধিক ২ (দুই) লক্ষ টাকা জরিমানার পরিবর্তে শুধুমাত্র অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে;
• কোন পণ্যের এইচ.এস. কোড নির্ধারনে অগ্রিম রুলিং জারী হওয়ার তারিখ হতে ১৮ (আঠার) মাসের পরিবর্তে ৩৬ (ছত্রিশ) মাস পর্যন্ত কার্যকর রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে;
• ইপিজেডস্থ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য Industrial Racking System (H.S.Code 7308.90.20) এবং Metal Detector Machine (H.S. Code 8543.70.90) আমদানির ক্ষেত্রে সকল প্রকার শুল্ককর হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে;
পোশাক শিল্পের সুরক্ষায় বিজিএমইএ এর আরও কিছু প্রস্তাবনা ছিলো, যা ঘোষিত বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো:
• কারখানাকে আধুনিক, নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত ও পরিবেশ বান্ধব এবং পরিচালনা ব্যয়সা শ্রয়করতে আরও তালিকার বাইরে থাকা কিছু যন্ত্রপাতি উপকরণ সমূহ শুল্কমুক্ত/রেয়াতি হারে আমদানির অনুমোদন দেয়া।
• পোশাক খাতের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবা ভ্যাট মুক্ত রাখা;
• এইচ.এস.কোড সহজীকরণ, বন্ডেড প্রতিষ্ঠান হতে নন-বন্ড প্রতিষ্ঠানে পণ্য ও সেবা সরবরাহ, সাব-কন্ট্রাক্ট, স্থানীয় নন-বন্ড প্রতিষ্ঠানে পণ্য ও সেবা সরবরাহ, বার্ষিক প্রাপ্যতা সীমা নির্ধারণ, কন্টিনিউয়াস বন্ড সংক্রান্ত কার্যক্রম সহজীকরণ।
• সার্কুলার ফ্যাশন ওরি সাইকেল পণ্যকে উৎসাহিত করতে রিসাইক্লিং শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া, পণ্য ও সেবাকে শুল্ক ও ভ্যাটের আওতা মুক্ত রাখা।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প সহপ্রত্যক্ষ ভাবে ১ কোটিলোক ও পরোক্ষভাবে ৫ কোটি লোকের জীবন-জীবিকা পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল এ শিল্পকে ঘিরে সমগ্র অর্থনীতি আবর্তিত হচ্ছে। তাই, এখাত টিকে নিবিড় সহায়তা দেয়া যৌক্তিক বলে বিজিএমইএ মনে করে।
বিজিএমইএ আশা করে যে সরকার উপরোক্ত সুপারিশগুলো সহৃদয়তার সাথে বিবেচনা করবেন।
এআর
আপনার মতামত লিখুন :