৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বৈশাখের অর্থনীতি!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০১৮, ১০:৩৯ পিএম
৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বৈশাখের অর্থনীতি!

ঢাকা : বৈশাখ বরণ এখন শুধু গ্রামের নয়, রীতিমতো নাগরিক উৎসবও। অনেক দিন ধরেই কংক্রিটের জঞ্জাল এই ঢাকাতেও বাংলা নববর্ষকে আবাহন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসবে পরিণত হয়েছে। গত তিন বছর ধরে দিবসটি উদযাপনে সরকারি কর্মজীবীরা ভাতাও পাচ্ছেন। তবে সবাই এই উৎসব ভাতা না পেলেও সব ধর্ম ও শ্রেণির মানুষ এ দিনটিকে কেন্দ্র করে সাধ্যমতো পরিবারের সদস্যদের জন্য নতুন পোশাক, ভালো খাবার, উপহার আর বেড়ানোর ব্যবস্থা করেন। ফলে বৈশাখকেন্দ্রিক অর্থনীতি দিন দিন বড় আকার নিচ্ছে।

তবে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে কত টাকা হাতবদল হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তার পরও ব্যবসার হালচাল ও কিছু পুরনো প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ধারণা করা যায় বৈশাখের অর্থনীতি ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এক গবেষণায় বৈশাখের ব্যয়ের একটি চিত্র তুলে ধরেছিল।

‘পহেলা বৈশাখ : অর্থনৈতিক তাৎপর্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের বাংলা নববর্ষে সারা দেশে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয় বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মেহেরুননেছা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এরপর কেটে গেছে আরো কয়েকটি বছর। আর গত তিন-চার বছরে বৈশাখকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের কলেবর অনেকটাই বেড়েছে। ফলে এখন অর্থপ্রবাহ আরো অনেক বেশি হবে।

বৈশাখের অর্থনীতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত ঈদুল ফিতরের অর্থনীতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের একটি সমীক্ষা রয়েছে। সেটিও ২০১৫ সালে তৈরি। সেই সমীক্ষার সঙ্গে বৈশাখের অর্থনীতির তুলনা করলে দেখা যায়, ঈদে দেশে পোশাক, খাদ্যপণ্য, বিনোদন ও পরিবহন খাতে বাড়তি যোগ হয় এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। বৈশাখে খরচ হয় এর এক-চতুর্থাংশ। সে ক্ষেত্রে বৈশাখের অর্থনীতি দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার।

বৈশাখে সবচেয়ে বড় আয় করছে পোশাক খাত। এ সময় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের তৈরি পোশাকের অধিকাংশ সরবরাহ করে কেরানীগঞ্জের প্রতিষ্ঠানগুলো। জানা গেছে, গত তিন মাস ধরে ওই এলাকায় দিনরাত চলছে জামা-কাপড় তৈরি ও সরবরাহের কাজ। কেরানীগঞ্জ তৈরি পোশাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ স্বাধীন জানান, সেখানে সাত হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠানে এ বছর ৮ কোটি বৈশাখী পোশাক তৈরি হয়েছে। এর মূল্য সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

কেরানীগঞ্জের এসব পোশাক সরবরাহ হচ্ছে সারা দেশের ছোট-বড় মার্কেট, বিপণিবিতান শপিং মল থেকে শুরু করে ফুটপাথ পর্যন্ত। আবার এসব পোশাকের পাশাপাশি বুটিক হাউজগুলোর বিক্রিও অনেক বাড়ে এ সময়। যেহেতু বাংলা নববর্ষে দেশি পোশাকের চাহিদা একচেটিয়া, তাই ফ্যাশন হাউজগুলোর কেনাবেচা ঈদের চেয়েও বেশি হয়।

দেশি ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ফ্যাশন এন্টারপ্রেইনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফইএবি) তাদের তথ্যে বলছে, বছরে তাদের ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার বেচা-বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই হয় বৈশাখে। সে হিসাবে রাজধানীর ফ্যাশন হাউজগুলো বৈশাখে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে।

পোশাকের পাশাপাশি এ সময় বাড়ে সাজসজ্জার উপকরণসহ উপহারসামগ্রীর বিক্রিও। ইদানীং আবার এসব পণ্যের বিক্রি বেড়েছে অনলাইনে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশের অন্যতম ই-কমার্স সাইট আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘যেকোনো সাধারণ দিনে আজকের ডিল প্রায় দেড় হাজার পণ্য ডেলিভারি করে। কিন্তু বৈশাখের কারণে গত এক মাস ধরে এ সংখ্যা আড়াই হাজার পেরিয়ে গেছে।’  

দেশে ই-কমার্স সাইটগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার পণ্য বিক্রি হয় জানিয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, বৈশাখ উপলক্ষে এ বিক্রি প্রায় ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে বলে আমারা ধারণা করছি। অর্থাৎ ই-কমার্সে প্রতিদিন আড়াই কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে। আর বৈশাখ উপলক্ষে এমন বেচাকেনা চলে এক মাস ধরে।

সারা দেশে বৈশাখী মেলাগুলোয় মৃৎশিল্প সামগ্রীর বেচাকেনার পরিমাণও কম নয়। মৃৃৎশিল্পীরা সারা বছরের বিক্রির এক-চতুর্থাংশ করে বৈশাখী মেলায়। এ সময় প্রতিটি মৃৎপল­ী তিন-চার মাস কর্মচঞ্চল থাকে। পণ্য তৈরি হয় কোটি টাকার বেশি।

নববর্ষে জমজমাট ব্যবসা চলে শুভেচ্ছা কার্ড, ব্যানার-ফেস্টুন ও বাংলা ক্যালেন্ডারেরও। ফলে মুদ্রণশিল্পেও অর্থের জোগান বাড়ে। বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির মতে, সারা দেশেই কমবেশি বৈশাখী কর্মকাণ্ড চলে। ফলে সাত হাজারের বেশি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের বেশি কাজ হয়।

বৈশাখ ঘিরে ফুল ব্যবসাও চাঙ্গা হয়। সাধারণ দিনে রাজধানীতে যে পরিমাণ ফুল কেনাবেচা হয় বৈশাখে তা কয়েক গুণ বাড়ে। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বাবুল প্রসাদ জানান, গত বছরের পহেলা বৈশাখে ঢাকায় ২০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল। এ বছর তা আরো বাড়বে। এ ছাড়া রাজধানীর বাইরেও প্রচুর ফুল বিক্রি হয়।

বৈশাখে খাবারের পেছনেও অনেক খরচ হয়। বিশেষ করে ইলিশ, ফলমূল আর মিষ্টিতে। বাজারে বৈশাখের আগেই ইলিশের দাম চড়ে যায় চাহিদার কারণে। ফলমূল ও মিষ্টি উপহার বিনিময় চলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অফিস আদালতে।

সারা দেশে হালখাতার রেওয়াজ কমলেও বৈশাখে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শুভাকাক্সক্ষীদের মিষ্টি ও ফলমূল পাঠানোর নতুন রেওয়াজ চালু করেছে। সচ্ছলরা আবার সে সময় তাদের নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতেও মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়। ফলে বেড়ে যায় মিষ্টির দোকানে ভিড়।

সুইটস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, আগে এসএসসি রেজাল্টের সময় সব থেকে বেশি মিষ্টি বিক্রি হতো। এখন পহেলা বৈশাখে। অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ও ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক মাধব চন্দ্র ঘোষ বলেন, বৈশাখে আমাদের প্রতিটি বড় দোকানে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ মণ মিষ্টি বিক্রি হয়। আবার অনেক কোম্পানি আগে থেকেই করপোরেট প্রতিষ্ঠানে অর্ডারের মাধ্যমে প্রচুর মিষ্টি সরবরাহ করে। আর সারা দেশের মেলাগুলোতে মিষ্টির পসরা তো বাড়ে।

এ ছাড়া নববর্ষে সারা দেশে পার্ক-উদ্যান, পাড়া-মহল­ায় ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বৈশাখের ছুটিতে পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে আগেভাগেই বুকিং শেষ হয়ে যায়। মেলে না বাস ট্রেন বা বিমানের টিকেট। গ্রামগঞ্জে চলে ঐতিহ্যবাহী কয়েক ডজন মেলা। শহরেও হয় বৈশাখী মেলা। দিবসটি উপলক্ষে নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। সঙ্গে মিউজিক ভিডিও, বই, নাটকসহ নানা অনুষ্ঠানের টাকা যোগ হয় সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!