তিন মাসে খেলাপি ১৪ হাজার কোটি টাকা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ৪, ২০১৮, ১১:১০ পিএম
তিন মাসে খেলাপি ১৪ হাজার কোটি টাকা

ঢাকা : দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাস জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে আরো ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা খেলাপি যুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের গণ্ডি ছাড়িয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা, যার অর্ধেকই রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের। আবার মোট খেলাপি ঋণের ৭৩ হাজার কোটি টাকাই ‘মন্দ ঋণ’, যা আর আদায় করা সম্ভব হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক কথায়, পাহাড়সমান খেলাপি ঋণে এখন বেহাল দেশের ব্যাংক খাত।

এর পেছনে সুশাসনের ঘাটতিকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এই সংখ্যা স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ। উল্লি­খিত সময় ব্যাংক ব্যবস্থায় মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব  বলছে, মোট খেলাপির অর্ধেকই রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের। মার্চ শেষে এর পরিমাণ ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এ সময় ব্যাংকগুলো বিতরণ করে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা ঋণ। গত ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, তিন মাসের ব্যবধানে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। মার্চ শেষে বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এই সময়ে ব্যাংক দুটির ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ শতাংশ। এই সময়ে তাদের মোট ঋণের স্থিতি ছিল ৬ লাখ ২১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি ৪০টি ব্যাংকের খেলাপি ছিল ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সে সময় বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় ৬ লাখ ৩ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা।  

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে পরিচালিত ৯টি বিদেশি মালিকানার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সবচেয়ে কম। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৮৮ কোটি, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। এ সময় তারা মোট ঋণ দিয়েছে ৩১ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। অর্থাৎ বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ সামান্য বাড়লেও হার কমেছে।  

খেলাপি ঋণকে তিনটি শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়। নিম্নমান, সন্দেজনক ও মন্দ বা খারাপ। ধরে নেওয়া হয়, মন্দ ঋণ আদায় হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, মোট খেলাপির ৭৩ হাজার কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। অর্থাৎ এই টাকা আর ব্যাংকগুলো ফেরত পাবে না।  

এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আতাউর রহমান প্রধান রোববার (৩ জুন) বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এখানে আমরাও রয়েছি। তবে একটি কথা বলতে চাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টই বলছে, ২০১৭ সালে বিতরণ করা রূপালী ব্যাংকের কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। এটি আমাদের সম্পর্কে ভালো বার্তা দিচ্ছে। বর্তমান পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় আমরা যারা রয়েছি, ঋণ অনুমোদনের আগে মানের দিকটি কঠোরভাবে পর্যালোচনা করছি। ফলে খেলাপি ঋণের এই পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসব। রূপালী ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ খেলাপি এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।  

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণের উচ্চ পরিমাণ ও হারের কারণ ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব। এই ঘাটতি এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ছিল। বেসরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতির ভয়ে ঋণ বিতরণে সতর্ক থাকত। কিন্তু এখন আর সে পরিস্থিতি নেই। সার্বিকভাবে খেলাপি কমাতে তদারকি ও পদক্ষেপে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

খেলাপির উচ্চ হারের সঙ্গে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হারের সম্পৃক্ততা রয়েছে জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, কোনো ব্যাংক শতকরা ১১ টাকা খেলাপি হলে তাকে বাকি ৯০ টাকা থেকে আয় করতে হচ্ছে। আমানতের সুদ পরিশোধ, পরিচালন ব্যয় মিটিয়ে মুনাফা করতে হলে তাকে ঋণে উচ্চ সুদ নিতে হয়। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে নজর না দিয়ে ব্যাংকগুলোকে কেবল সুবিধা দিলে কোনো লাভ হবে না।  

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!