ভিক্ষায় চলে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মেকআপম্যানের সংসার!

  • বিনোদন প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০১৮, ০১:৩২ পিএম
ভিক্ষায় চলে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মেকআপম্যানের সংসার!

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জুর মেকআপ করেছিলেন এ সময়ের ভিক্ষুক হারুন

ঢাকা: ভিক্ষা করে চলে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মেকআপম্যান কাজী হারুনের সংসার!  ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র মতো ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে তিনি মেকআপম্যান হিসেবে কাজ করেছেন, কুড়িয়েছেন প্রশংসা। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ ছবিতে কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কিন্তু এখন দিন যাপন করছেন ভিক্ষাবৃত্তি করে; তাঁর নাম কাজী হারুন। ভিক্ষার টাকা দিয়েই এখন চলছে তাঁর চিকিৎসা ও সংসার খরচ।

কাজী হারুন থাকেন দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ফরিদাবাদ বস্তিতে। সঙ্গে থাকেন স্ত্রী মহুয়া আকতার। তিনটি বাড়িতে কাজ করে ঘর ভাড়া দেন স্ত্রী মহুয়া, আর ভিক্ষা করে জীবনধারণের খরচ চালান হারুন।

ভিক্ষা করছেন কাজী হারুন

১৯৭৯ সালে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন হারুন। ১৯৮৯ সালে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিতে কাজ করে তিনি প্রশংসিত হন। ২০০৯ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (ব্রেইন স্ট্রোক) হয় তাঁর, এতে শরীরের ডান পাশ প্রায় পুরোটা অকেজো হয়ে যায়। অসুস্থ হওয়ার কারণে আর কাজ করতে পারছিলেন না, তাই ছিটকে পড়েন চলচ্চিত্র জগৎ থেকে, শুরু হয় অর্থকষ্ট। অনেকটা বাধ্য হয়েই ২০১১ সাল থেকে তিনি ভিক্ষা করতে শুরু করেন। অভাবের তাড়নায় এরই মধ্যে তিনি বিক্রি করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সোনার মেডেল। বেঁচে থাকার জন্য হতদরিদ্র, বাকশক্তি হারানো হারুনের ভিক্ষাই একমাত্র উপায়।

স্বামীর অসুস্থ হওয়ার ভয়াবহ দিনটি স্মরণ করে স্ত্রী মহুয়া আকতার বলেন, ‘২০০৯ সালে গাজীপুরের হোতাপাড়া থেকে একটি সিনেমার শুটিং শেষ করে বাড়ি ফেরেন। তারপর বাথরুমে যাওয়ার পর আমরা দেখি, তিনি আর বের হচ্ছেন না। উঁকি দিয়ে দেখি, তিনি নিচে পড়ে আছেন। তাড়াতাড়ি আমরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। প্রায় তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। বাড়িতে যে জমানো টাকা ছিল, সব খরচ হয় হাসপাতালে। এখনো তিনি ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। শরীরের ডান পাশটা প্রায় কাজ করে না বললেই চলে।’

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে পাওয়া মেডেল সম্পর্কে মহুয়া বলেন, ‘আমার মেয়ের বিয়ে হয় ২০১০ সালের দিকে। তখন আমাদের হাতে কোনো টাকা ছিল না। বাড়িতে যে টাকা ছিল, তা চিকিৎসার জন্য ব্যয় হয়েছে। যে কারণে বাধ্য হয়ে আমরা মেডেলটি বিক্রি করেছি। মেডেলে এক ভরি স্বর্ণ ছিল। তখন স্বর্ণের দাম ছিল মাত্র আট হাজার টাকা। আর যে পুরস্কারটি ছিল, সেটি বিক্রি করতে পারিনি। কারণ পিতলের কোনো দাম নাই। সেটা আমরা ফেলে দিয়েছি।’

স্ত্রী মহুয়া আকতারের সঙ্গে কাজী হারুন

কবে থেকে হারুন ভিক্ষা করছেন—এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী মহুয়া। তখন তাঁর পাশে নীরবে কাঁদছিলেন হারুনও। স্ত্রী মহুয়া  বলেন, ‘মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর আমাদের ঘরে আর কোনো টাকা অবশিষ্ট ছিল না। বাড়ি ভাড়া দিতে পারি না, ঘরে খাবার নাই। আমি এরই মধ্যে পাশের এক বাড়িতে কাজ করে কিছু খাবার সংগ্রহ করি। একদিন আমি অসুস্থ হই, কিন্তু তিনি (হারুন) কিছুই করতে পারেন না।

আমি রাগ করে উনাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিই। তাঁকে বলি, কিছুই যখন করতে পারেন না, যান ভিক্ষা করেন। তার পরও তো বেঁচে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। তারপর বের হয়ে গেলেন বাসা থেকে। এক মাস আমরা অনেক খুঁজেছি। কিন্তু উনাকে কোথাও পাইনি। তারপর একদিন বাড়ি এলেন। বললেন কমলাপুর ছিলেন, দিন-রাত ভিক্ষা করেছেন, রাতে ইট মাথায় দিয়ে ঘুমিয়েছেন। আমার হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিলেন। তার পর থেকেই ভিক্ষা করা শুরু।’

এখন কীভাবে সংসার চলছে—জানতে চাইলে মহুয়া বলেন, ‘এখন তো আর আমরা ওই বাড়িতে থাকি না, বস্তিতে দেড় হাজার টাকা দিয়ে একটা ছোট রুমে থাকি। আমি তিনটি বাড়িতে কাজ করি। সেখানে থেকে পাঁচশ করে দেড় হাজার টাকা পাই, সেই টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া দিই। আর তিনি ভিক্ষা করে দিনে দু-তিনশ টাকা পান, সেই টাকা দিয়ে বাজার আর উনার ওষুধ কিনি। উনি অসুস্থ, প্রতিদিন তো আর ভিক্ষা করতে পারেন না। যে কারণে প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হয়।’

একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে ঠিকই, তবে মেয়ের সংসারও যে খুব ভালো চলছে তা নয়, তারাও গরিব। শিল্পীর জীবন থেকে এখন ভিক্ষুকের জীবন কাটানো হারুন তাই সরকারের সহযোগিতা চান। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহুয়া বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। তিনি তো কত শিল্পীকেই সহযোগিতা করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তিনিই তো হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এখন এই মানুষটা অসুস্থ হয়ে কাজ করতে পারছেন না, ভিক্ষা করে আর কত দিন চলবে? আমি মেয়েমানুষ হয়ে বাসাবাড়িতে কাজ করতে পারি। কিন্তু এই দিয়ে তো আর সংসার চলে না। আরেকটু বয়স হলে তো আর ভিক্ষাও করতে পারবেন না। আপনারা আমাদের জন্য কিছু করেন। প্রধানমন্ত্রী যেন আমাদের কিছুটা সাহায্য করেন।’

একসময়ের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিয়ে মহুয়া বলেন, ‘আমার বিয়ের দুই বছর পর তিনি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিতে কাজ করেন। তার পর থেকে দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন তিনি। আমরা অনেক সুখেই ছিলাম। কিন্তু একটা ব্রেইন স্ট্রোক আমাদের সব শেষ করে দিল। যারা উনাকে সালাম দিয়ে পথ ছেড়ে দিত, আজ তারা দয়া করে ভিক্ষা দেয়। আর পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে একদিন আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছাড়াও তিনি ‘অন্য জীবন’, ‘শঙ্খমালা’, ‘গোলাপী এখন ঢাকা’, ‘জীবন সংসার’সহ শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন।

সোনালীনিউজ/বিএইচ

Link copied!