নতুন গ্যালারি স্থাপনের উদ্যোগ

দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

  • রাজশাহী ব্যুরো | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২৪, ০৬:১৩ পিএম
দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

রাজশাহী: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। যুগের পর যুগ ধরে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে আসছে দুস্পপ্রাপ্য প্রত্ন সম্পদে সমৃদ্ধ এ সংগ্রহশালা। নগরীর প্রাণকেন্দ্র হেতম খাঁ এলাকায় অবস্থিত এই জাদুঘরে পাল, সেন, মৌর্য ও গুপ্ত আমলসহ হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। কিন্তু অবকাঠামো সংকটের কারণে মাত্র এক হাজার ১০০টি নিদর্শন ৪৭টি প্রত্নবস্তু গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। বাকি প্রায় ১৮ হাজার নিদর্শন গ্যালারি সংকটের কারণে প্রদর্শন করা যাচ্ছে না। একারণে জাদুঘর পরিচালকের বাস ভবনের নিচ তলার ঘরগুলো সংস্কার করে নতুন গ্যালারি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ছাড়াও দর্শনার্থীদের পদচারণায় প্রায় সবসময় মুখর থাকে এ জাদুঘর। বর্তমানে এটি  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধীন। নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজপরিবারের বিদ্যোৎসাহী জমিদার কুমার শরৎকুমার রায়, খ্যাতনামা আইনজীবী ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং  রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দ্রের প্রচেষ্টায় ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ জাদুঘর।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংগ্রহ ও অনুশীলনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১৯০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের কাশিমবাজার পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরের বছর পরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ভাগলপুরে। শরৎকুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রমাপ্রসাদ উভয় অধিবেশনে যোগ দিয়ে বরেন্দ্রভূমির পুরাকীর্তি সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং পুরাকীর্তি সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ১৯১০ সালে তারা বগুড়া জেলার খঞ্জনপুরে পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে যান এবং এর ঐতিহ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য একটি সমিতি গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে গঠন করেন বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি।

সমিতি অনুসন্ধান চালিয়ে  রাজশাহী জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে কালো পাথরের বিখ্যাত গঙ্গামূর্তিসহ পুরাতত্ত্বের ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করে। কুমার শরৎকুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও রমাপ্রসাদ সমিতির ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যক্তিগত যে অর্থ দেন তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় কম। তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার সমিতিকে ১০০ টাকা করে অনুদান দিতো। এ আর্থিক অনটনের মধ্যে সংগৃহীত নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের জন্য একটি জাদুঘর ভবন নির্মাণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং তা ব্যয়বহুল জানার পরেও শরৎকুমার বন্ধুদের অনুরোধে নির্মাণকাজ শুরু করেন। সমিতির কর্মকর্তাদের অনুরোধে তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নির্মাণ শেষে ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর উদ্বোধন করেন লর্ড রোনাল্ডসে।

১৯৪৭-এর পর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর মারাত্মক দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে। এ জন্য এটি রক্ষা ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে ১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর হস্তান্তর করা হয়  রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে।

১৯১১ সালে কলকাতা জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরের যাবতীয় সংগ্রহ নিজেদের দাবি করেছিল। ফলে এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে তৎকালীন  রাজশাহী বিভাগের কমিশনার এফ জে মনোমোহনের প্রচেষ্টায় বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল বরেন্দ্র জাদুঘর পরিদর্শনে এসে সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। ১৯১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সরকারি সার্কুলারের মাধ্যমে স্থানীয় জাদুঘরগুলোকে সংগ্রহের বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হলে এ জাদুঘরের অস্তিত্ব রক্ষা হয়। প্রস্তর ও ধাতব প্রতœভাস্কর্য, টেরাকোটা, মুদ্রা ও পা-ুলিপি, মৃৎপাত্র ও পোড়ামাটির ফলক, অস্ত্রশস্ত্র, আরবি ও ফারসি দলিলপত্র, চিত্র, ধাতবসামগ্রী এবং শিলালিপি মিলে প্রায় ১৯ হাজারের মতো প্রতœনিদর্শনের ঐতিহাসিক সমাহার বাংলাদেশের রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।

জাদুঘরটিতে নিদর্শনগুলো প্রদর্শনের জন্য সাতটি প্রদর্শন কোষ্ঠ বা গ্যালারি রয়েছে। গ্যালারিতে প্রদর্শিত রয়েছে, সিন্ধু সভ্যতার (খ্রিস্ট পূর্ব ২৫০০) প্রত্নসম্পদ।

ফারসি ফরমান ও বাংলা দলিলপত্র, পুরনো বাংলা হরফে সংস্কৃত লিপি, চকচকে টালি, ইসলামি রীতির ধাতব তৈজসপত্র, হাতে লেখা কুরআন শরিফ, বাংলা ও সংস্কৃত পা-ুলিপি, বাংলাদেশের পাহাড়পুরে (অষ্টম-দ্বাদশ শতক) উৎখননকৃত প্রত্নসম্পদ, মোগল চিত্রকলা, পাথর ও ব্রোঞ্জ নির্মিত বিভিন্ন ভাস্কর্য, বিহারের নালন্দা এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনাবলি।

হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রস্তর মূর্তি এবং কাঠের আধুনিক ভাস্কর্যসমূহ। প্রদর্শিত রয়েছে হিন্দু ভাস্কর্য, সূর্য মূর্তি, শিব মূর্তি, গণেশ মূর্তি এবং বিষ্ণু মূর্তি। দুর্গা-গৌরী-উমা-পার্বতী, মাতৃকা ও চামু-া মূর্তি। বৌদ্ধ মূর্তি, জৈন তীর্থঙ্কর, বোধিসত্ত্ব, তারা ও এবং হিন্দুধর্মের গৌণ দেব-দেবীর মূর্তি।

আরবি, ফারসি, সংস্কৃত এবং প্রাচীন বাংলা প্রস্তর লিপি, মুসলিম যুগের খোদিত পাথর, মিহরাব, অলঙ্কৃত চৌকাঠ ও লিন্টেল এবং শেরশাহের আমলে নির্মিত দুটি কামান। বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিদর্শন। বারান্দার ওপরের সারিতে পাহাড়পুর থেকে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলক সাজানো রয়েছে। হিন্দু-বৌদ্ধ ভাস্কর্যরাজি। প্রাঙ্গণে সজ্জিত রয়েছে হিন্দু ও মুসলমান স্থাপত্যনিদর্শন খোদাইকৃত পাথর, পাথরের স্তম্ভ, শিবলিঙ্গ ইত্যাদি। প্রাচীন ইতিহাস গবেষণায় অনন্য অবদান রেখে চলেছে এই জাদুঘরটি।

সম্প্রতি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে জাদুঘরের সংস্কার কাজ করা হয়েছে। গ্যালারির সৌন্দর্য বর্ধণের কাজ করা হয়েছে। জাদুঘরের ডেপুটি চিফ কনজারভেশন অফিসার মো. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, প্রতিনিয়তই জাদুঘরে গবেষক, দর্শনার্থী আসেন। তবে গ্যালারির সংখ্যা আগের ৪৭টিই আছে। নতুন একটি গ্যালারির বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। সেটি করা সম্ভব হলে এক হাজার ১০০টি প্রদর্শিত নিদর্শনের বাইরে আরও কিছু নিদর্শন প্রদর্শন করা সম্ভব হবে।

এমএস

Link copied!