মহাকর্ষ বল না থাকলে কেমন হবে মহাবিশ্ব

  • সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ৪, ২০১৬, ০৫:১৩ পিএম
মহাকর্ষ বল না থাকলে কেমন হবে মহাবিশ্ব

সোনালীনিউজ ডেস্ক

এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর অসংখ্য বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে যে ধারণাটি তা হলো- ‘মহাকর্ষীয় তরঙ্গ’, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় gravitational waves। ঠিক ১০১ বছর আগে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারণা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তবে সম্প্রতি মহাকর্ষীয় বল কীভাবে কাজ করে সে রহস্য উদঘাটনের ঘোষণা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বৃহস্পতিবার তারা জানিয়েছেন, শতবর্ষ আগে দেয়া আইনস্টাইনের তত্ত্বটি সঠিক।

আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ধারণা প্রকাশ করেন। যাতে বলা হয়েছিল, ১৪’শ কোটি বছর আগে মহাবিস্ফোরণ বা ‘বিগ ব্যাং’ পরবর্তী উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল। যা এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এখনো ছড়িয়ে পড়ছে। অবশেষে তারই প্রমাণ পেলেন বিজ্ঞানীরা।
 
তার মানে আমরা সব সময়ই এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মধ্যে বসবাস করছি। আর এটা বোঝা যায়, মানুষ যখন লাফ দেয়। হতে চায় ‘সুপারগার্ল’ বা ‘সুপারম্যান’। কারণ আপনি যতই সুপারগার্ল কিংবা সুপারম্যান হতে চান না কেন- আপনাকে আসলে আছড়ে পড়তে হবে ভূমিতে। তবে কল্পনার জগতে সুপারম্যান হতে দোষ কোথায়? কিছুক্ষণের জন্য না হয় মহাকর্ষের সুইচটাকে বন্ধ করে দেই।

আসলে কী ঘটবে যদি সত্যিই মহাকর্ষ বলে কিছু না থাকে? এ ব্যাপারে পদার্থবিজ্ঞান কিন্তু খুবই ‘গোঁড়া’। সে কল্পনার ধারে কাছেও যাবে না। বলবে, এমনটা ঘটা কখনোই সম্ভব না। আমরা আপাতত পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে একটু কল্পনার জগতেই থাকি। ধরে নিই মহাকর্ষ বলে কিছু নেই। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বিভিন্ন মতামত।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার একসমেয়র নভোচারী জে বাকির মতে, মহাকর্ষের অনুপস্থিতি প্রভাবিত করবে মানবদেহকে। আমাদের দেহ আসলে পৃথিবীর মতো একটি মহাকর্ষীয় পরিবেশের সাথে সঙ্গতি স্থাপন করে নিয়েছে। আমরা যদি মহাকাশ স্টেশনের মতো কোনো জায়গায় সময় কাটাই তবে আমাদের দেহের পরিবর্তন সাধিত হবে।

মহাকাশ স্টেশনে এভাবেই ভেসে থাকে মহাকাশচারীরা-
এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে মহাকাশ ভ্রমণের সময় মহাকাশচারীরা তাদের হাড়ের ভর এবং পেশিশক্তি হারান। সেই সাথে পরিবর্তন আসে তাদের ভারসাম্যজ্ঞানে। নিজের দেহের ওপর ভারসাম্য ধরে রাখতে পারেন না তারা।

আরেক গবেষক কেভিন ফং জানান আরো একটি সমস্যার কথা। মহাকর্ষ না থাকলে আমাদের দেহে লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ কমে যেতো। এতে তৈরি হতো এক ধরনের রক্তস্বল্পতা, যাকে বলা যায় ‘স্পেস এনিমিয়া’ বা ‘মহাকাশ রক্তস্বল্পতা‘। এ সমস্যা কাটতে লাগতো বেশ কিছুটা সময়। আর এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতো আমাদের দেহ। এমনকি ক্ষতি হতো আমাদের ঘুমের। তবে এসবের কারণ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি ফং।

ফংয়ের কথাগুলো পুরোটাই মহাকাশে সামান্য সময় ঘুরে আসার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। তবে আমরা যদি মহাকর্ষবিহীন একটা জায়গার স্থায়ী বাসিন্দা হতাম। অথবা আমাদের যদি বেড়ে উঠতে হতো মহাকর্ষবিহীন কোনো জগতে, কী ঘটতো তবে? জে বাকি জানিয়েছেন, এমনটা হলে আমাদের মাংসপেশি, আমাদের দেহের ভারসাম্য ব্যবস্থা, আমাদের হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালী গঠিত হতো ভিন্নভাবে।  

এমন একটি পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল একটি বিড়াল। মহাকর্ষবিহীন পরিবেশে বিড়ালটি বেড়ে ওঠার পর দেখা যায়, একটি মাত্র চোখ নিয়ে বড় হয়েছে বিড়ালটি। তাও আবার অক্ষিকোঠরের নিচে স্থায়ীভাবে লুকানো। তার মানে বিড়ালটি বেড়ে উঠেছিল অন্ধ হয়ে। এমনকি চোখের সাথে মস্তিষ্কের সংযোগকারী সার্কিটটিও তৈরি হতে পারেনি। কারণ, দেখতে না পাওয়ায় চোখ থেকে কোনো তথ্য মস্তিষ্কে সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি বিড়ালটির। এটা আমাদের পুরনো সেই বাগধারাটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘হয় ব্যবহার করো অথবা হারাও’।

এতে বোঝা যায়, বিড়ালের চোখের মতো আমাদের দেহের বাকি অংশগুলোর পরিণতিও একই রকম হতো। আমাদের হৃৎপিণ্ড, মাংসপেশি এবং হাড়ের চারপাশে যদি মহাকর্ষ ছড়িয়ে না থাকতো তবে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ভিন্নভাবে বেড়ে উঠতো- এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তার মানে মহাকর্ষের সুইচটা বন্ধ করে দিলে আমরা দেখতে হতাম ভিন্ন এক ধরনের প্রাণি। এমন একটা অদ্ভুত দেহ নিশ্চয়ই সুখকর হতো না!

যুক্তরাজ্যের মহাকাশচারী কারেন মাস্টারস মহাকর্ষবিহীন দৈহিক অবস্থার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, আমাদের পৃথিবী সব সময়ই উচ্চ গতিতে ঘুরছে। তবে এ ঘূর্ণনে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় থাকছে। কারণ মাহকর্ষ এখানে আমাদের বেঁধে রাখা এক ধরনের তন্তুর মতো কাজ করে। বিভিন্ন বস্তু ভূমির সাথে একভাবে লেগে থাকছে মহাকর্ষের কারণে। আর মহাকর্ষ না থাকলে বস্তুগুলোর অবস্থা হতো ভাসমান। শূন্যে ভেসে থাকতো তারা। এমনকি চলে যেতে পারতো ভূমি থেকে অনেক উপরে।

আর যাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতো তারা হয়তো হারিয়ে যেতো ধরাপৃষ্ঠ থেকে। তবে অট্টালিকাগুলোতে বাস করা লোকজন কিছুটা নিরাপদে থাকতে পারতো। কারণ এগুলো ভূমিতে খুব শক্ত করেই গেঁথে দেয়া থাকে। স্থায়ীভাবে না হলেও তারা অন্তত কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারতো- এমনটাই মনে করেন মাস্টার্স।

ভূমিতে গেঁথে না রাখলে সবকিছুই উড়তে শুরু করতো। পৃথিবীর চারপাশের উপাদানসমূহ, সাগর, নদী এবং হ্রদগুলো সবার আগে মহাশূন্যে উড়তে শুরু করতো। গবেষক জোলেনি ক্রেইটন লিখেছেন, এমনটা হলে আমার নিশ্চিতভাবেই মারা পড়তাম। মাস্টার্সের মতে, এতে পৃথিবী অসংখ্য টুকরায় বিভক্ত হয়ে যেতো এবং মহাশূন্যে ভেসে বেড়াতো।

ফিরে যাওয়া জিনিসগুলোই আবার ফিরে আসতো-
সূর্যের ক্ষেত্রেও ঘটতো একই পরিণতি। সূর্য তার কেন্দ্রে থাকতে পারতো না। ভেঙে পড়তো একটি মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। মহাবিশ্বের অন্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর ভাগ্যও একইভাবে নির্ধারিত হতো। শেষ পর্যন্ত গ্রহ-নক্ষত্রের মতো কোনো বস্তুই আর আমাদের মহাবিশ্বে খুঁজে পাওয়া যেতো না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো কিছু পরমাণু। হয়তো চারদিকে ঘুরে বেড়াতো তারা। তবে লাগতো না কোনো কাজেই।

ভেবে দেখুন পৃথিবীকে সচল রাখার জন্য মহাকর্ষ কতটা দরকার। মহাকর্ষ না থাকলে থাকতো না আমাদের পৃথিবীর মতো অনন্য সুন্দর একটি জায়গা। এমনকি থাকতো না আমাদের বাংলামেইলের ওয়েবসাইটটিও!

পৃথিবীকে সচল রাখতে চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ প্রধানতম। বাকি তিনটির মধ্যে একটি হলো: ইলেকট্রোমেগনেটিজম বা ত্বড়িচ্চৌম্বকীয় বল। এটি তড়িৎ এবং চৌম্বকের মধ্যকার সম্পর্ককে বর্ণনা করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, কম্পিউটারে স্মৃতি সংরক্ষণ, টেলিভিশন পর্দায় ছবি ফুটিয়ে তোলা, রোগব্যাধি নিরূপণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই তড়িচ্চুম্বকীয় বল ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে আমরা যা যা করি তার সবকিছুতেই তড়িচ্চুম্বকীয় বলের ফল।

দ্বিতীয়টি হলো: শক্তিশালী পারমাণবিক বল। এটি বস্তুর মৌলিক কণাগুলোকে (ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ও অন্যান্য) একসাথে বেঁধে রেখে বৃহৎ কণিকা তৈরি করে। এটি দূরের কণাগুলোকে একসাথে বাঁধতে পারে।

তৃতীয়টি হলো: দুর্বল পারমাণবিক বল। এটি শক্তিশালী পরমাণবিক বলের মতোই কাজ করে। তবে শক্তির দিক থেকে এটি খুব স্বল্প দূরত্বের মধ্যে কাজ করে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ‘বেটা ক্ষয়’ এই বল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

এই চারটি মৌলিক বল না থাকলে গঠিত হতে পারতো না পরমাণু। বিবিসি অবলম্বনে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Link copied!