২৭ বছর পর হারানো বান্ধবী ফিরিয়ে দিল ফেসবুক!

  • জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম ব্যুরো | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০১৯, ০৪:৪৫ পিএম
২৭ বছর পর হারানো বান্ধবী ফিরিয়ে দিল ফেসবুক!

সিলেটের মাহবুবা শিউলী ফিরে পেলেন তার ছোট্ট বেলার খেলার সাথী মেঘবতীকে

চট্টগ্রাম : বন্ধু পাওয়া যায় সেই ছেলেবেলায় স্কুল-কলেজেই। প্রাণের বন্ধু। তারপর আর না। আর না? সারা জীবনে আর না? জীবন জুড়ে যারা থাকে তারা কেউ কারো বন্ধু নয়। তারা দু’রকমের। এনিমি আর নন-এনিমি। নন-এনিমিদেরই বন্ধু বলে ধরতে হয়। আবেগ আর বাস্তবতায় মিশ্রিত কথাগুলো বলেছিলেন প্রখ্যাত লেখক শিবরাম চক্রবর্তী।

জানি না কথাটি কতটুকু সত্য! তবে ৩৭ বছর পরে চট্টগ্রামে বসবাস করা সিলেটের মাহবুবা শিউলী ফিরে পেলেন তার ছোট্ট বেলার খেলার সাথী মেঘবতীকে। আর জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিল। চোখ ভেঁজা কান্নায় আবেগে নিজেকেও স্বাভাবিক রাখতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মেঘবতী। বর্তমানে স্বামীর সংসার নিয়ে যিনি ঢাকায় ফিরলেন।

সেই অতীত! কত নির্মম। দেখতে দেখতে মাঝখানে দু’জনের বহু সময় পেরিয়ে যায়। যায় দিন, যায় মাস, বছর ঘুরে কখন যে ২৭টি বসন্ত কেটে গেছে না দেখা দু’জনের। স্কুলজীবন হতে দু’জনের বিছিন্নতা। পরিবর্তন হয়েছে নিজেদের। বড় হয়ে ভার্সিটিও শেষ করলেন। ১৯৯৩ সালের কথা, ছিলো না সে সময় ফেসবুক।  

সময়ের আবর্তনে বদলে গেছে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু বদলে যায় নাই মাটির টান আর বন্ধুত্ব। আর তাই তো ৩৭ বছর পর ফেসবুকের মাধ্যমে হঠাৎ দু’জনের দেখা হলো। এ যেন অন্য আনন্দ, অন্য অনুভূতি। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বন্ধুকে কাছে পেয়ে নিরবে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছে দু’জনের। এ অশ্রু যেন খুশির। ধন্যবাদ দেওয়া হয় সৃষ্টিকর্তা ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে। একদিন অবসরে টাইমলাইনে ঘুরতে ঘুরতে মেঘবতীকে পেলেন সে অনেক কথা অনেক যাচাই-বাছাই।

সমসাময়িক কলাম লেখক মাহবুবা শিউলী বলেন, ‘সব সময় মনে হতো আমার বান্ধবী বেঁচে আছে। ওর জন্য কত রাত কেঁদেছি ঠিকমতো খেতে পারিনি। রাতে ঘুমাতে পারিনি। কখন আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে। আজ যেন আকাশের চাঁদ আমি হাতে পেয়েছি।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয় রাজধানী ঢাকায় দুই বান্ধবীর দেখার মাধ্যমে। দেখা শেষে দু’জনের কত ছবি তোলা। কত ঘোরাঘুরি দু’পরিবারের সঙ্গে এক সঙ্গে খাওয়া আর স্মৃতি। অতঃপর বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) রাত ৯টা ২৩ মিনিটের সময় কলামিস্ট মাহবুবা শিউলী তার নিজস্ব ফেসবুক স্ট্যাটাসে দু’জনের ছবিসহ একটি পোস্ট করেন যা পাঠকের চোখে তুলে ধরা হল হুবহু।

‘মেঘবতী আমার!! ফুল ফুটে ফুল ঝরে ভালোবাসা ঝরে পড়ে না ভালোবাসা ঝরে পড়ে না। এ কথাটা সত্য হয়েছে আমার আর মেঘবতীর অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে। মেঘবতী! আমার শিশুবেলার বান্ধবী। ক্লাস টু থেকে ক্লাস সিক্সের প্রথম কিছুদিন পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আমার আব্বু নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ সহ আরো চারটা থানার সার্কেল এএএসপি ছিলেন। সেই সুবাদে মোহনগঞ্জে আমরা টানা চার বছর ছিলাম।

মেঘবতীকে ঘিরে কত স্মৃতি মোহনগঞ্জে! আমার আব্বুর সততা ও জনপ্রিয়তার কারণে টানা চার বছর মোহনগঞ্জ থাকতে হয়েছে কিন্তু নিয়মানুযায়ী একদিন ট্রান্সফার হলো। আমরাও মোহনগঞ্জ ছেড়ে কুমিল্লার মুরাদনগর চলে আসলাম। হঠাৎ বিচ্ছেদ আমাদের ছোট্ট হৃদয় মেনে নিতে পারেনি। কুমিল্লা আসার পর টেলিফোনে মাঝেমাঝে কথা হতো। আমি কাঁদতাম, মেঘবতীও কাঁদতো। আমি নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। ব্যস্ত হলাম। কিন্তু মেঘবতী আমায় হারিয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল।

আমরা স্কুলে এক সঙ্গে থাকতাম টিফিন টাইমে হয় আমি ওর বাসায় নতুবা সে আমার বাসায় চলে আসতো, একসঙ্গে খেতাম আবার স্কুল ছুটির পর ওদের পুকুরে গোসল করতাম, সাঁতার কাটতাম। বিকেল বেলা হয় ওদের বাসায় নতুবা আমাদের বাসায় সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলায় খেলায় কাটাতাম। বিকেলে একসঙ্গে মুকুল ফৌজ করতাম।

আহ্ কত আনন্দের ও মজার ছিল ওর আর আমার বন্ধুত্বের দিনগুলো। তাই হঠাৎ আমার সঙ্গে বিচ্ছেদ মেনে নেওয়া ওর পক্ষে খুবই সমস্যা হয়েছিল। একদিন রাতেও আমাদের বাসায় থাকবে বলে কত্ত আবদার। আমিও খুশিতে ছাড়ি না। কিন্তু অনেক রাতে আন্টি এসে জোর করে নিয়ে যায় কারণ আঙ্কেল ছিলেন খুবই রাগী মানুষ। সে কি কান্না!! যাবে না। খাট বিছানা বালিশ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল! জোর করে টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে। সেইদিনের সেই স্মৃতিও আমার মনের মনিকোঠায় জলজল করছে। আমরা চলে যাবার পর তাই ওকে স্বাভাবিক করতে প্রতিদিন আমাদের ওই সরকারি বাসভবন থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে হতো!

সেই মেঘবতী আমার! আজ কত্ত বছর পর আমি আমার মেঘবতীর দেখা পেলাম! কিভাবে আবার যোগাযোগ! ফেসবুকের কল্যাণে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া মেঘবতীকে পুনরায় ফিরে পেয়েছি। ফোন করে একে অপরের সঙ্গে কথা বলেছি। একজন আরেকজনকে দেখার জন্য অস্থির হয়েছিলাম। সে এখন ঢাকায় থাকে। আমি বলি তুই চট্টগ্রাম বেড়াতে আয়। সে বলে তুই ঢাকায় আয় আমার বাসায়। দুই বন্ধু মিলে সারাদিন সারারাত আড্ডা দেব।

অবশেষে কিছুদিন আগে ঢাকায় কাজের জন্য যাওয়া হয়! আমি আমার মেঘবতীর বাসায় দুইরাত তিনদিন ছিলাম। মেঘবতী তোকে বলতে চাই, বন্ধু তোকে কখনো ভুলিনিরে। মনে মনে তোকে কত যে খুঁজেছি! বড় হয়ে ভেবেছিলাম তোর খুঁজে আবার মোহনগঞ্জ যাবো।

পেয়েছি বন্ধু তোকে আমি পেয়েছি। তোকে অনেক ভালোবাসিরে মেঘবতী। তোর জীবনসঙ্গী জাহিদ ভাইয়াও অসাধারণ একজন মানুষ। মহান আল্লাহ তোকে তোর উপযুক্ত একজনের সঙ্গে জোড়া মিলিয়ে জাহিদ ভাইকে পাঠিয়েছেন। ভালো থাকিস বন্ধু আমার অনেক ভালো থাকিস। তোদের জন্য হৃদয়ের অতলান্ত থেকে অফুরান দোয়া রইলো বন্ধু।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Link copied!