হেফাজত ইস্যুতে কৌশলী বিএনপি

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২১, ১১:১৬ এএম
হেফাজত ইস্যুতে কৌশলী বিএনপি

ফাইল ছবি

ঢাকা : হেফাজতে ইসলামের চলমান আন্দোলনে বিএনপি কি কোনো রকম 'ইন্ধন' জোগাচ্ছে? রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ কষে এ আন্দোলনে দলটি পরোক্ষভাবে হলেও সমর্থন দিতে পারে বলে আভাস দিচ্ছেন রাজনীতি-বিশ্নেষকরা। হেফাজতকে নেপথ্যে থেকে সমর্থন, অর্থ ও জনবল জোগান দেওয়ার সরাসরি অভিযোগও বিএনপির বিরুদ্ধে করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও প্রভাবশালী মন্ত্রীরা। 

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বিষয়ে 'কৌশলী' অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। এ সংগঠনটির সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনো রকম সংযোগ না রাখলেও আড়ালে 'নিবিড়' যোগাযোগ রাখছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, আগামীতে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নির্বাচনে ধর্মনির্ভর এ সংগঠনের 'প্রভাব' কাজে লাগাতে চায় দীর্ঘ এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটি।

অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, হেফাজতে ইসলাম একটি ধর্মীয় সংগঠন। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো রকম সম্পর্ক নেই। বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুসারে যে কোনো গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে সমর্থন জানানোর সুযোগ রয়েছে। গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে হেফাজত ও বাম দলগুলো কর্মসূচি দেয়। ওই সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি। যে কোনো সংগঠন যৌক্তিক দাবিতে কর্মসূচি পালন করতে পারে। তাতে বাধা দিয়ে মানুষ হত্যাকে বিএনপি সমর্থন করে না।

এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। একটি ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এটা ক্ষমতাসীন দলের অপপ্রচার। লন্ডনে বসে তারেক রহমান হেফাজত নেতাদের মদদ দিচ্ছেন বলে আওয়ামী লীগ নেতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটাই আওয়ামী লীগের সমস্যা। তারা সবকিছুর মধ্যে বিএনপি-ভূত দেখে। কথায় কথায় এ জন্যই তারেক রহমানের নামে বিষোদ্গার করে।

দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সরকারের 'দুঃশাসনের' বিরুদ্ধে সোচ্চার যে কোনো দল ও সংগঠনের কর্মসূচির প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাবে বিএনপি। হেফাজত রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তখন আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বা জোট করা-না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি এখন শুধু তাদের কর্মসূচিতে মানুষ হত্যার ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। একই সঙ্গে হেফাজতের ডাকা হরতালেও নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে।

সর্বশেষ গত সোমবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওলামা-মাশায়েখদের গ্রেপ্তারের নিন্দা ও মুক্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বিএনপির এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যাও দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। তারা এটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে জানায়। বিএনপি নেতা বলেন, সংবিধান প্রত্যেক ব্যক্তিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার অধিকার, সামাজিক মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করার এখতিয়ার দিয়েছে। সংবিধান-প্রদত্ত সেই অধিকার কেউ কেড়ে নিয়ে অন্যায় ও অবিচার করলে বিএনপি তার প্রতিবাদ করবে এবং ন্যায়ের পক্ষে থাকবে।

বিএনপির বিভিন্ন স্তরে খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, দেশি-বিদেশি চাপের মুখে দলের হাইকমান্ড প্রকাশ্য অবস্থান না নিয়ে হেফাজত ইস্যুতে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। যার অংশ হিসেবে হেফাজতের কর্মসূচিতে নৈতিক সমর্থন এবং কর্মী হত্যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত এসেছে। সারাদেশে বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মী এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে বলে দাবি করছেন নেতারা।

তাদের মতে, জামায়াতে ইসলামীকে ২০ দলীয় জোটে রাখা-না রাখার ব্যাপারে দলের মধ্যে তুমুল পক্ষ-বিপক্ষ রয়েছে। কিন্তু হেফাজত ইস্যুতে দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীর মতো স্বাধীনতার বিরোধিতা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না হেফাজত। তারা শুধু ইসলামের কথা বলে এবং মজলুম জনতার ভূমিকা পালন করে। হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সাম্প্রতিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারটিকে তার ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপি নেতারা। তাদের মতে, এর সঙ্গে সারাদেশের ওলামা-মাশায়েখদের কোনো সম্পর্ক নেই।

তাদের আরও যুক্তি হচ্ছে, হেফাজত ও আলেম সমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারকে সুবিধা পাইয়ে দিতে চায় না বিএনপি। তারা এখন যে কোনো মূল্যে সরকারের বিদায় চায়। সরকারকে চাপে ফেলতে পারে, এমন যে কোনো শক্তির পক্ষে বিএনপির নীরব সমর্থন রয়েছে, থাকবে। এমন প্রেক্ষাপট থেকেই হেফাজতের সঙ্গে দলটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে বলে জানা যায়।

সংশ্নিষ্টদের মতে, জামায়াতের সঙ্গে জোট এবং ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় বিএনপির কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ কারণে হেফাজতের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেবে না তারা। তবে ভবিষ্যতের আশা-ভরসা থেকে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করে যাওয়ার অবস্থান নিয়ে এগোচ্ছে তারা।

এ বিষয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক এলডিপি মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা শুধু হেফাজত নয়; যে কোনো দল ও সংগঠনের কর্মসূচির প্রতি সমর্থন এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো ২০ দলীয় জোটের নৈতিক দায়িত্ব।

বিএনপির নীতিনির্ধারক হিসেবে পরিচিত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথমত, ইসলামী শক্তি বলে পরিচিত হেফাজতকে তারা চটাতে চাইছে না। দ্বিতীয়ত, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে 'মৌলবাদী' হিসেবে পরিচিত হতেও রাজি নয় দলটি। ধর্মীয় ইস্যু তৈরি করে সরকার বিএনপিকে মাঠে নামাতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপি এ ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক। কারণ দলটির অনেক নেতা মনে করেন, ধর্মীয় মৌলবাদের কোনো ইস্যুর সঙ্গে এখন বিএনপিকে জড়াতে পারলে সরকার লাভবান হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটা তুলে ধরা হবে- বিএনপি মৌলবাদ সমর্থনকারী একটি দল।

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিরিজ বৈঠকেও হেফাজত ইস্যুসহ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চলছে। সেখানেও দলের হাইকমান্ড থেকে নেতাদের জানানো হয়, শুধু বিএনপি নয়; সরকার সব দল ও মতের ওপর নির্যাতন শুরু করেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছুই করা যাবে না।

এদিকে শীর্ষ নেতা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের নতুন কমিটিতে সরকারপন্থিদের তুলনায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সমর্থকদের প্রাধান্য বলে মনে করা হয়। গত ১৫ নভেম্বর ঘোষিত নতুন কমিটির ১৬৭ জনের মধ্যে বেশিরভাগ নেতাই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সমর্থক বলে আলোচনা রয়েছে। তা ছাড়া নতুন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত নন; বরং বিএনপির সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির প্রকাশ্য সম্পর্ক না থাকলেও গোপন যোগাযোগ যথেষ্ট রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে হেফাজতে ইসলাম নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। এক সময় বিএনপিকে হেফাজতের ঘনিষ্ঠ মনে করা হতো। পরে তারা সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত পেল। আবার এখন সরকার হেফাজত ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রকৃত রাজনৈতিক বিশ্নেষণ করতে হলে বলতে হয়, হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য রাজপথে কোনো স্পেস না থাকায় অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যেসব কর্মসূচি রাজনৈতিক দলগুলোর পালন করার কথা, এখন সেগুলো করছে অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠনগুলো। রাজনৈতিক শূন্যস্থানটিই এখন হেফাজতের মতো সংগঠন দখল করেছে। এটাই এখনকার প্রধান রাজনৈতিক সংকট।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকারই এখন হেফাজতকে বিএনপির কোলে ঠেলে দিয়েছে। এটা সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সুখকর নাও হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে হেফাজতকে ঢাকার শাপলা চত্বরে আসার পথ দেখিয়েছিল আওয়ামী লীগই। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সুযোগটি কাজে লাগিয়ে হেফাজতের পাশে দাঁড়িয়ে কাছে টেনে নিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার হেফাজতকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সমঝোতা করেছিল। রাজনৈতিক শূন্যতা কাজে লাগিয়ে হেফাজত আবার রাজপথে নামার সুযোগ নিয়েছে। সরকার তাদের নির্যাতন করায় বিএনপি আবার পাশে দাঁড়িয়ে কাছে টানার চেষ্টা করছে। সবকিছু মিলিয়ে শূন্য রাজনৈতিক অবস্থায় এ ধরনের পরিস্থিতি বারবার ঘটতেই থাকবে।

এদিকে সংগঠনের এক নেতার জবানবন্দি উব্দত করে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালনের এক সপ্তাহ আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে জুনায়েদ বাবুনগরীর গোপন বৈঠকের যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সেটি মিথ্যা অভিহিত করেছে সংগঠনটি। গতকাল বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো হেফাজতের এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাবুনগরীর বৈঠক দূরের কথা, সাক্ষাৎও কখনও হয়নি।

ভাস্কর্য ইস্যুতে ভিন্নমত : এদিকে, হেফাজতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নৈতিক সমর্থন দিলেও তাদের মতো বিএনপি ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধী নয়। দলীয় সূত্র দাবি করেছে, মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্য থাকায় তারা বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যৌক্তিক মনে করে না। তা ছাড়া নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য রয়েছে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের। আওয়ামী লীগ ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিলেও ভাস্কর্য ইস্যুতে বিএনপি হেফাজতের পাশে ছিল না। সূত্র: সমকাল।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Link copied!