ঢাকা : লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিশাল বিস্ফোরণে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে আরো ৪ হাজারের বেশি মানুষ।
লেবাননের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান বলেছেন, অত্যন্ত বিস্ফোরক রাসয়নিক পদার্থের গুদামে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এই বিস্ফোরণ দুর্ঘটনা। পরিকল্পিতভাবে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়নি। তারা বলছেন গুদামে ছয় বছর ধরে মজুত রাখা অত্যন্ত বিপজ্জনক বিস্ফোরক থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব এই ঘটনাকে বিপর্যয় বলে বর্ণনা করেছেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন।
প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন এক টু্ইট বার্তায় বলেছেন, কোনো গুদামে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মতো বিস্ফোরক অনিরাপদভাবে মজুত রাখার বিষয়টি ‘অগ্রহণযোগ্য’।
বুধবার (৫ আগস্ট) মন্ত্রিসভার বিশেষ একটি বৈঠক ডেকেছেন প্রেসিডেন্ট আউন।
বুধবার থেকে তিন দিনের জন্য লেবাননে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক পালন করা হবে।
উদ্ধারকর্মীরা এখনো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে ভুক্তভোগীদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছে, তা নিশ্চিতভাবে জানার উদ্দেশ্যে তদন্ত চলছে।
সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান ও বিবিসি জানাচ্ছে, বিস্ফোরণে আহতদের ভিড় উপচে পড়ছে বৈরুতের হাসপাতালগুলোতে। একসঙ্গে এতো আহত মানুষের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেক পোড়া রোগী ও রক্তাক্তদের নিতে পারছে না হাসপাতালগুলো। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য চেয়েছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী।
স্বাস্থকর্মী ও দেশটির রাজনীতিবিদেরা হাসপাতালের আহতদের রক্তদান করতে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের লেবানিজ শাখা।
ঘটনার ভয়াবহতার বর্ণনা করতে গিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে রেডক্রসের লেবানিজ শাখার প্রধান জর্জ বলেন, ‘আমরা ভয়াবহ এই বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছি। বিস্ফোরণস্থলের পাশে কিংবা সেখান থেকে অনেক দূরের রাস্তাগুলোতে যত্রতত্র আহত ও নিহত মানুষ পড়ে আছে।’
লেবাননের রাষ্ট্র-পরিচালিত ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি (এনএনএ) জানিয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জোড়া বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা বৈরুত শহর। বিস্ফোরণ অনুভূত হয়েছে দেড়শো কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। প্রথম দিকে বিষয়টিকে ভূমিকম্প ভেবেছিল সেন্ট্রাল বৈরুতের বাসিন্দারা।
এদিকে ঘটনার পর পর টুইটারে বিস্ফোরণের দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, সেন্ট্রাল বৈরুতের আকাশে ধোঁয়ার লাল কুণ্ডুলী। এর পরপরই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে সেন্ট্রাল বৈরুতের বাসিন্দাদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণটি এত শক্তিশালী ছিল যে বাসিন্দারা ভেবেছিল ভূমিকম্প হয়েছে। মানুষজন চিৎকার, ছুটোছুটি করেছে। বাসিন্দাদের তোলা ভিডিও এবং ছবিতে শহর জুড়ে ভবনগুলোর দরজা ও জানালার গ্লাস ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
টুইটারে এক বাসিন্দা বিস্ফোরণের ভিডিও আপলোড করে লিখেছেন, ঘটনাস্থল থেকে তার বাড়ি ১০ কিলোমিটার দূরে। অথচ এতো দূরেও তার এলাকা কেঁপে উঠেছে। এবং তার বাড়িসহ আশপাশের ভবনগুলোর জানালার কাচ ভেঙে পড়েছে।
বিস্ফোরণটি কী কারণে ঘটেছে, তা এখনও স্পষ্টভাবে বলা না গেলেও ঘটনাস্থলে আতশবাজি থাকায় আগুন লাগার পর এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে, আতশবাজির এক গুদাম থেকে এই বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। তবে লেবাননের রাষ্ট্র-পরিচালিত ন্যাশনাল নিউজ এজেন্সি (এনএনএ) বলছে, বন্দর এলাকায় একটি বিস্ফোরকের ডিপোতে আগুন লাগার পর ওই বিস্ফোরণ ঘটে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, যে স্থানটিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখানে বন্দরের গুদাম রয়েছে। রাসায়নিকের মজুদ থাকা বন্দরের গুদামে প্রথম আগুন লাগার কথা জানা গেছে।
এদিকে লেবাননের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে বলেছেন, বন্দরে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করা ছিল। তা থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে।
লেবাননের প্রেসিডন্ট মিচেল ওন দেশের সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেছেন, বিস্ফোরণের জন্য যারাই দায়ী হোক, তাদের চরম মাশুল দিতে হবে।
কী হয়েছিল : মঙ্গলবার বৈরুত স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার ঠিক পরই বিস্ফোরণটি ঘটে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে ধ্বংসস্তুপের নিচে মানুষকে আটকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, বিস্ফোরণের আওয়াজ ছিল তীব্র ও কান ফাটানো। ভিডিও ফুটেজে অনেক গাড়ি এবং ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে বলে দেখা গেছে।
বন্দর এলাকা থেকে পাওয়া ভিডিওতে প্রথম বিস্ফোরণ স্থল থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলি উঠতে দেখা যায়। টুইটারে অনেকে মোবাইল ফোনে তোলা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ভিডিও শেয়ার করেন।
টুইটারে পোস্ট করা এই ভিডিওর সাথে বলা হয়, তারা বিস্ফোরণ স্থল থেকে ১০ কিমি দূরে থাকেন এবং বিস্ফোরণে তাদের ভবনের কাঁচ ভেঙে গেছে।
বিস্ফোরণের প্রভাব ২৪০ কিলোমিটার দূরের পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ সাইপ্রাসেও অনুভূত হয়েছে। সেখানকার মানুষ মনে করেছিল, আশেপাশে ভূমিকম্প হয়েছে।
প্রথম বিস্ফোরণের পর আরেকটি আরো বড় বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় আশপাশের ভবনগুলো ঢেকে যেতে দেখা যায়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে বলেন, বিস্ফোরণ এত শক্তিশালী ছিল যে তার মনে হয়েছিল তিনি মারা যাবেন।
হাসপাতাল আহতদের ভিড়ে উপচে পড়েছে বলে বলা হচ্ছে।
বিবিসির একজন সংবাদদাতা জানিয়েছেন, নিকটবর্তী হাসপাতালে এত আহত মানুষকে আনা হয়েছে যে, সেখানে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না।
দমকল কর্মীরা অনেকগুলো আগুন নেভাতে হিমশিম খেয়েছে।
প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের সভাপতিত্বে সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক হয়েছে এবং সরকারকে রাজধানী বৈরুতে দু সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা জারির সুপারিশ করা হয়েছে।
এই বিস্ফোরণ ঘটেছে একটা স্পর্শকাতর সময়ে।
দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাফিক হারিরিকে ২০০৫ সালে হত্যা মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে এ সপ্তাহেই।
গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে হারিরির হত্যায় চারজন সন্দেহভাজনের মামলার রায় জাতিসঙ্ঘের একটি ট্রাইব্যুনালের দেবার কথা শুক্রবার।
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কী : অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়, তবে এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় কৃষিকাজে সার এবং বিস্ফোরক হিসেবে।
আগুনের সংস্পর্শে এলে এটি অত্যন্ত সক্রিয় বিস্ফোরক হিসেবে কাজ করে। আর বিস্ফোরিত হলে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং অ্যামোনিয়ার মত বিষাক্ত গ্যাসও নির্গত হতে পারে।
যেহেতু এটি অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুদ করে রাথার জন্য কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয় - বিশেষ করে মজুদ করার জায়গাকে এমনভাবে নিরাপদ করতে হয় যেন আগুন না লাগে।
এছাড়া লক্ষ্য রাখতে হয় যেন কোনো নালা বা ড্রেইনে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জমা হয়ে বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি না করতে পারে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :