নানা জটিলতায় আটকে আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণ

  • কাজল সরকার, হবিগঞ্জ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ৩, ২০১৮, ০৭:১৫ পিএম
নানা জটিলতায় আটকে আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণ

হবিগঞ্জ : আজ ৪ এপ্রিল, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক একটি দিন। একাত্তরের এই দিনে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোয় দেশকে স্বাধীন করার শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবং সেখানেই রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন আতাউল গনি ওসমানী।

মেজর খালেদ মোশাররফ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা দেওয়ান আশ্রব আলীকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত যাওয়ার মতো একটি রাস্তা করার নির্দেশ দিলে চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়। ২ এপ্রিল কর্নেল এমএজি ওসমানী প্রথম সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় পৌঁছেন এবং ওইদিন বিকালে ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যাটালিয়ন কমান্ড্যান্ট পাণ্ডেকে তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারে পাঠান। তিনি তেলিয়াপাড়া পৌঁছে লে. কর্নেল এমএম রেজা, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সাফায়েত জামিলসহ আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৪ এপ্রিল সকালে ১টি জিপ ড্রাইভারসহ আশ্রব আলীকে একজন সৈনিক দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়। সেখানকার সিদাই থানা থেকে এমএজি ওসমানীকে নিয়ে আসার জন্য বিকালে এসে মাগরিবের নামাজের পর এমএজি ওসমানী তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বড় বাংলোর ২য় তলায় ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিয়ে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকেই পুরো রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন আতাউল গনি ওসমানী।

বৈঠকে রাজনৈতিক আন্দোলন জোরদার, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল ম্যাপ রচনা করা হয়। ওই দিনের ঐতিহাসিক বৈঠকে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, সাবেক এমপি মওলানা আসাদ আলী, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) কাজী কবির উদ্দিন, তৎকালীন ছাত্রনেতা শাহ মো. মুসলিম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী পাঠানসহ অনেক স্থানীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে মুক্তিবাহিনীকে প্রথমে মুক্তিফৌজ নামকরণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে তা মুক্তিবাহিনী নামে আত্মপ্রকাশ করে। যুদ্ধকালীন সময় একাধিকবার মেজর জিয়া রামগড় থেকে ভারত হয়ে তেলিয়াপাড়ায় আসেন।

১লা এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে টার্গেট করে বাঙালি সেনাবাহিনী ২য় ও ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেড কোয়ার্টার এখানে প্রথম স্থাপন করা হয়। তেলিয়াপাড়ার এ বাংলো থেকেই ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল এমএজি ওসমানী নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ওয়্যারলেসে পাকবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ ও গোপন তথ্য পাঠানোর এক অভিযোগে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের তৎকালীন ব্যবস্থাপক বিহারি জরিপ খানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে, মুক্তিযুদ্ধের সেদিনের স্মৃতি হিসেবে ও ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরের শহীদদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলোর পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বুলেট আকৃতির স্মৃতিস্তম্ভ। কিন্তু সেখানে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণের ৩ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ৭ মে তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের আয়োজনে এক মহাসমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হেলাল মুর্শেদ খান ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হক তেলিয়াপাড়াকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন এলাকায় রুপান্তরের ঘোষণা দেন। এ সময় তারা ওই স্থানে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। শুধু ঘোষণাই নয়, প্রায় ৩ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দও দেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এলাকাটি চা বাগানের মধ্যে হওয়ায় ন্যাশনাল টি কম্পানি (এনটিসি) বেঁকে বসেছে। এনটিসি’র আপত্তির কারণে এসব প্রকল্প কয়েক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। এ নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক মধু বলেন, ‘আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে তেলিয়াপাড়ায় একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে রয়েছে। আমরা চাই সকল সমস্যা সমাধান করে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।

সদর উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল সহিদ জানান, সরকার তেলিয়াপাড়াকে একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র করার প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পটি কি কারণে আটকে আছে জানি না। আমরা চাই এটিকে যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা হোক।

এ ব্যাপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী পাঠান জানান, ‘৭১- এর মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্থানটির স্মৃতি সংরক্ষণে যুদ্ধকালীন সময়ের সেক্টর কমান্ডার কাজী মো. সফিউল্লাহ বীর উত্তম পিএসসি তার উদ্যোগে ১৯৭৫ সালের জুন মাসে তেলিয়াপাড়ায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। ন্যাশনাল টি কোম্পানির তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোর পূর্ব দক্ষিণে বুলেট আকৃতির স্মৃতিসৌধ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতিসৌধে স্থান পেয়েছে কবি শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি কবিতাটি।’

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ওই স্থানটিতে জাদুঘর ও মিউজিয়াম করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে ৩ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে এই প্রকল্পের কাজ এখন বন্ধ রয়েছে। কাজ দ্রুত শুরু করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Link copied!