কমবে বর্জ্যদূষণ

হাইড্রোজেন জ্বালানিতে সম্ভাবনার হাতছানি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০৩:৫৭ পিএম
হাইড্রোজেন জ্বালানিতে সম্ভাবনার হাতছানি

ঢাকা : বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ বর্জ্য পাওয়া যায় তা থেকে ৫৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ১৮.২২ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ২০১৮ সালে ‘হাইড্রোজেন এনার্জি গবেষণাগার স্থাপন প্রকল্প’ গ্রহণ করে সরকার।

প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য-হাইড্রোজেন উৎপাদন, মজুত এবং সরবরাহ সংশ্লিষ্ট গবেষণা ও মান নিয়ন্ত্রণ এবং সে লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ ও জাতীয় পর্যায়ের একটি রেফারেন্স সেন্টারের আঙ্গিকে সেবা প্রদান। ২০২২ সাল নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে মাইলফলক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের তিনটি বড় সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে হাইড্রোজেন এনার্জির মধ্যে।

প্রথমত, বাণিজ্যিক উৎপাদন সফল হলে মিথেন বা এলএনজির বিকল্প হিসেবে যানবাহন, বাসাবাড়ি ও কারখানায় হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহারের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এর ফলে দেশে প্রতি বছর ৬১ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকার জ্বালানি তেল আমদানির খরচ অনেকটাই কমে আসবে।

দ্বিতীয়ত, দেশে প্রতি বছর ২২৭ মিলিয়ন টনেরও বেশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকার বিভাগকে হিমশিম খেতে হয়। অথচ এই প্রকল্পের মূল কাঁচামালই হলো এসব বর্জ্য। ফলে সেখানেও অনেক সাশ্রয় হবে।  

আর তৃতীয়ত, বর্জ্যের দ্বারা সৃষ্ট দূষণও কমে আসবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)।

সম্প্রতি প্রকল্পের অধীনে হাইড্রোজেন উৎপাদন পাইলট প্ল্যান্টের ১০ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিসিএসআইআর-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ বলেন, ‘প্রকল্পটির কাজ চলমান রয়েছে এবং আশা করছি আগামী বছরের মধ্যে শেষ হবে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে মেশিনারিজ এনে সেগুলো স্থাপনের কাজ চলছে।’

তিনি জানান, প্রথমবারের মতো সংযোজিত প্রসেস প্ল্যান্টটি বাংলাদেশের গবেষণা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর অনুকরণে বাণিজ্যিক উৎপাদনের শিল্পকারখানা স্থাপন করা সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই শিল্পের সম্প্রসারণের মধ্য দিয়েই জয় হবে জ্বালানি সক্ষমতা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষমাত্রা (জ্বালানি মিক্সের ১০%)। পানিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে হাইড্রোজেন উৎপাদনের প্রযুক্তিও শীঘ্রই সংযোজন হবে। এই প্রযুক্তির দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে গত ১৮ জানুয়ারি সপ্তাহব্যপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু হয়েছে।

এদিকে ৪৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৬ শতাংশ।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়েছে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বৃদ্ধি এবং পাশাপাশি ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব তোলা হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শুরুতে প্রতিদিন ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে বিসিএসআইআর। প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামে ১৪ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর হাইড্রোজেন গবেষণাগার ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএসআইআর গবেষণাগার চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক (অতি. দায়িত্ব) ড. মোহাম্মদ মোস্তফা টেলিফোনে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। আর একান্তই কিছু জানতে চাইলে তিনি সশরীরে তার কার্যালয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের তালিকায় গ্যাস ও কয়লার মতো হাইড্রোজেনের অন্তর্ভুক্তি বিপুল সম্ভাবনাময়। হাইড্রোজেন একটি নবায়নযোগ্য ও সম্ভাবনাময় বিকল্প জ্বালানি যা পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। হাইড্রোজেনের জ্বালানি মান প্রচলিত জ্বালানি মানের প্রায় তিনগুণ (১৪২ কি.জু./গ্যা.)।

এ ছাড়া এটি ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণ হয় না। বিদ্যমান প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা জয় করে জ্বালানি হিসেবে এর ব্যবহার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রচলিত জ্বালানি ব্যবস্থার পাশাপাশি হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহারের জন্য বড় অবকাঠামো ও বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। পরিবহন ক্ষেত্রে জ্বালানি চাহিদা পূরণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি শিল্পকারখানায় হাইড্রোজেনের চাহিদা ক্রমবর্ধমান।

হাইড্রোজেনের অনন্য জ্বালানি বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি কার্যকর এনার্জি ট্রানজিশনে সক্ষম। জ্বালানি মিশ্রণে বৃহৎ আকারের নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্তর্ভুক্তি, শিল্পকারখানা ও যানবাহনের নির্গমন হতে পরিবেশ দূষণরোধ এবং অঞ্চলভিত্তিক এনার্জি বিতরণের মাধ্যমে এনার্জি সিস্টেমের সক্ষমতা অর্জনে হাইড্রোজেন প্রযুক্তি অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল চালিত যানবাহন অথবা সমন্বিত হিট ও পাওয়ার (ঈঐচং) ইউনিট হতে কোনো ধরনের পরিবেশ দূষণকারী পদার্থ নির্গত হয় না। হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল শুধু যাত্রী বহনের বাহন হিসেবে মুখ্য তা নয়; ট্রাক, রেল, বিমান ও জাহাজের জন্যও মৌলিক ডিভাইস।

বাংলাদেশে পানি ও বায়োমাসের প্রাচুর্যতার কারণে তা হতে উৎপাদিত হাইড্রোজেন জ্বালানি ও শক্তির নিরাপত্তা বিধানসহ পরিবেশ দূষণরোধ, শক্তির মজুত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে অগ্রগণ্য।

বিসিএসআইএর’র গবেষণা অনুযায়ী, ১ কেজি হাইড্রোজেন হতে ৩৩.৩৩ কি.জু./গ্যা এনার্জি পাওয়া যায়, যেখানে পেট্রোল, ডিজেল ও সিএনজি থেকে পাওয় যায় যথাক্রমে ১২ কি.জু./গ্যা. (প্রায়) ও ১৪.৭ কি.জু./গ্যা.।

গবেষণা আরো বলছে, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল কার ১ কেজি হাইড্রোজেনের মাধ্যমে ১০০-১৩১ কিলোমিটার পথ চলতে পারে। যেখানে ১ কেজি পেট্রোলে চলে মাত্র ১৬ কিমি। ব্যবহার উপযোগী অবস্থার জন্য হাইড্রোজেন জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে উৎপাদন, ডেলিভারি ও বিতরণ খরচ বিবেচনায় নিতে হয়।

বর্তমানে হাইড্রোজেনের ইউনিট মূল্য ৫ থেকে সাড়ে সাত ডলার।  হাইড্রোজেনের ইউনিট মূল্যের লক্ষ্যমাত্রা হলো চার ডলার।  ৯ লিটার পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ হতে ১  কেজি হাইড্রোজেন ও ৮ কেজি অক্সিজেন পাওয়া যায়। যার উৎপাদন খরচ অপারেশন টাইমের ভিত্তিতে ১ দশমিক ৬ থেকে ১০ ডলার।

অপরদিকে বায়োমাস গ্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে উৎপাদিত পাইপলাইন উপযোগী হাইড্রোজেনের মূল্য আড়াই থেকে সাড়ে তিন ডলার। ১ কেজি বায়োমাস হতে ০.০৮-০.১৩ কেজি হাইড্রোজেন পাওয়া যায়। প্রচলিত সকল জ্বালানি উৎস, যেমন পেট্রোলিয়াম, কয়লা, নিউক্লিয়ার শক্তি ও সিএনজি হতে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা যায়। পর্যাপ্ত জীবাশ্ম জ্বালানি উৎস না থাকায় বাংলাদেশকে প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করতে হয়।

ওয়ার্ল্ড হাইড্রোজেন কাউন্সিলের তথ্য বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে জ্বালানি চাহিদার ২০ শতাংশ পূরণ হতে পারে হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে।

জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন প্রযুক্তির উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণে কাজ শুরু করেছে অনেক আগেই। আর বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি গ্রহণ করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ২০১৭ সালে, হাইড্রোজেন এনার্জি ল্যাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!