দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০১৬, ০২:৩৭ পিএম
দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু

ঢাকা: বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর মূল কাজের উদ্বোধনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে গত ১২ ডিসেম্বর। উদ্বোধনের পর থেকেই পদ্মার বুকে ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে স্বপ্ন। ইতোমধ্যে সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের নির্মাণকাজ শেষের দিকে। নতুন বছরে এই দুটি পিলার যুক্ত করে প্রথম স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

এই সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্ন পূরণ হবে। ২০১৮ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। দ্বিতল এই সেতুর উপর দিয়ে চলবে যানবাহন ও নিচ দিয়ে ট্রেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে দিন-রাত পদ্মাপাড়ে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ।

নিজস্ব অর্থায়নে এটি এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবেও সেতুটি ব্যবহূত হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে।

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় সেতুর মূল পাইলিং ও নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর পর থেকেই দ্রুত এগিয়ে চলেছে নির্মাণকাজ। বর্যায় নদীভাঙনের কারণে কাজের গতি কিছুটা কমলেও শুকনো মৌসুমের সুবিধা কাজে লাগিয়ে গতি বাড়ছে আস্তে আস্তে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর সার্বিক নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৩৯ শতাংশ।

পদ্মা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল এবং প্রমত্তা নদীগুলোর একটি। বর্ষাকালে প্রমত্তা পদ্মা নদীতে স্রোতের বেগ অনেক বেশি থাকে। প্রতি সেকেন্ড স্রোতের সর্বনিম্ন গতিবেগ ৩ থেকে ৪ মিটার (১০ থেকে ১২ ফুট)। 

একদিকে গঙ্গা, আরেকদিকে ব্রহ্মপুত্র-দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদীর অববাহিকার পানি এই পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে নামছে। উজান থেকে নেমে আসা এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে হবে ব্রিজটিকে। সেই সঙ্গে নদীর দুই তীরে নদীশাসনে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হবে। এমন অনেক চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়েই এগিয়ে চলেছে সেতুর কাজ।

পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ কমিটির একজন সদস্য বুয়েটের সাবেক উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহ বলেন, এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। এভাবে এগোলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এই কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেতুর ফাউন্ডেশন (ভিত্তি) দেওয়া হচ্ছে ৩ মিটার আকৃতির পাইল দিয়ে। 

এজন্য এই পাইলকে ১১৭ মিটার (প্রায় ৩৮০ ফুট) পর্যন্ত ‘ড্রাইভ’ করতে হবে। বিশ্বে কোনো নদীর এতটা গভীরে গিয়ে সেতুর জন্য পাইলিংয়ের নজির খুব কম। প্রকৌশলীদের জন্য এটাও এক বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিটা কাজ শুরুর আগে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় বাইরে থেকে কাজের অগ্রগতি বোঝা যায় না। প্রাথমিক কাজ শেষ হলে অন্যান্য কাজ দ্রুত শেষ হবে।

পদ্মার দুই পাড় মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সম্প্রতি নদীপথে চীন থেকে আসা প্রায় ৮০ মিলিমিটার পুরু স্টিলপ্লেট কেটে ওয়েল্ডিং করে স্প্যান তৈরির কাজ চলছে প্রকল্প এলাকায়। ২০ থেকে ৩০ মিটার লম্বা এসব স্টিলের কাঠামো জোড়া দিয়ে ১৫০ মিটারের একটি স্প্যানে পরিণত হবে। দুই পিলারের মাঝখানে এই স্প্যান বসিয়ে তৈরি করা হবে সংযোগ। এর মধ্যে একটি পিলারের উপর স্থাপনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। বাকি দুটি সংযোজনের কাজ চলছে। 

এ ছাড়া আরও একটি স্প্যান চীন থেকে বাংলাদেশের কুতুবদিয়া বন্দরে এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য চীনে তৈরি রয়েছে আরও সাতটি স্প্যান। মোট ৪১টি স্প্যান দিয়ে তৈরি হবে পদ্মা সেতু। প্রতিটি স্প্যানের ওজন প্রায় ২ হাজার ৯০০ টন। চার হাজার টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি শক্তিশালী ক্রেন দিয়ে এই স্প্যান বহন করে সেতুর পিলারে স্থাপন করা হবে। প্রথম স্প্যান বসানোর পরই মূলত দৃশ্যমান হবে পদ্মা সেতুর একাংশ। 

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে দুটি স্প্যান বসিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করা হবে। চলতি মাসে প্রথম স্প্যান বসানোর কথা থাকলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সেই সময়সীমা কিছুটা পিছিয়ে গেছে। নতুন একটি হ্যামার যোগ হলে এ কাজে গতি আসবে। নতুন বছরের শুরুতে প্রথম স্প্যানটি বসানো সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন। স্প্যান তৈরির পাশাপাশি পদ্মায় এখন মূল সেতুর পাইল বসানোর কাজ চলছে। ২০১৭ সালের মধ্যে সবগুলো পাইল বসানো শেষ হবে, এমন আশা সংশ্লিষ্টদের। 

পদ্মা সেতুতে মোট পিলার থাকবে ৪২টি। এর মধ্যে ৪০টি পিলার থাকবে নদীর ভেতরের অংশে। দুটি থাকবে দুই প্রান্তে সংযোগ সেতুতে। নদীর ভেতরের ৪০টি পিলারের প্রতিটিতে ৬টি করে পাইল করা হবে। এজন্য মোট ২৪০টি পাইল করতে হবে। সংযোগ সেতুর দুটি পাইলে ১২টি করে ২৪টি পাইল করতে হবে।

পদ্মা সেতু ঘিরে হংকংয়ের আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মাপাড়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটন কেন্দ্র, হাইটেক পার্ক, জাহাজ নির্মাণের কারখানা, সোলার প্ল্যান্টসহ বড় বড় সব প্রকল্প।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পদ্মা সেতু। 

১৯৯৮-৯৯ সালে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর ফেব্রুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর নকশার জন্য পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। তবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালের জুন মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের সঙ্গে এই সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২৬ নভেম্বর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। সংশোধনীর পর সর্বশেষ এই সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Link copied!