আদালতের হাত সংসদ পর্যন্ত হতে পারে না

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০১৭, ১০:০৪ এএম
আদালতের হাত সংসদ পর্যন্ত হতে পারে না

ঢাকা: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আদালত ও সংসদ অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে  গিয়েছে। রায় নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছে সংসদ। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় সুপ্রিম কোর্টে বহাল রাখা নিয়ে সংসদে উত্তাপ ছড়িয়েছেন এমপিরা। সরকারি, বিরোধীদল ও স্বতন্ত্র এমপিরা একযোগে এ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন। 

পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিতে বিচার বিভাগের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার প্রত্যাশার কথাও জানান তারা। রোববার অনির্ধারিত বিতর্কে তারা রিভিউয়ের মাধ্যমে ষোড়শ সংশোধনী পুনর্বহাল করে সংবিধান, গণতন্ত্র, সংসদ ও দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, পাকিস্তান ছাড়া বিচারপতিদের অভিশংসনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি আর কোথাও নেই। সর্বোচ্চ আদালতই সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।

তাহলে সামরিক শাসনের আমলে প্রণীত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কীভাবে বৈধ হয়? পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকে কীভাবে?  তারা অভীন্ন কণ্ঠে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আইনমন্ত্রীর প্রতি দাবি জানানোর পাশাপাশি এমিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, বর্তমান সংসদ আদালতের এই রায় গ্রহণ না করলে তা কোনদিনই কার্যকর হবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন, কিন্তু তাদের হাত কোনোভাবেই জাতীয় সংসদ পর্যন্ত লম্বা নয়- হতে পারে না।

সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে অন্তত ১০জন এমপি এ নিয়ে বক্তব্য রাখেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভপতিত্বে আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিচারপতির অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রেখে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন।

এর আগে সুপ্রিম জুড়িশিয়াল কউন্সিলের পরিবর্তে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে ২০১৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। পরে ওই সংশোধনীর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট হলে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ই মে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে  সরকার পক্ষ আপিল করলে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন।

এর ওপর সংসদে আলোচনায় অংশ নেন-আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, জাসদের মাঈনউদ্দিন খান বাদল, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, স্বতন্ত্র এমপি রুস্তম আলী ফরাজী, অধ্যাপক আলী আশরাফ প্রমুখ। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, যারা দাবি করেন সংবিধান প্রণেতা, বাহাত্তরের সংবিধানকে শ্রেষ্ঠ সংবিধান বলেন- তাঁরা কীভাবে সেই বাহাত্তরের সংবিধানের বিরুদ্ধে কথা বলেন? আমি আদালতের রায় নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।

কিন্তু এমিকাস কিউরি হিসেবে যারা বক্তব্য রেখেছেন তারা অসত্য কথা বলেছেন, জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। ড. কামাল হোসেনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সংবিধান প্রণয়নের সময় আমরা ভারতের সংবিধানকে ফলো করেছিলাম। এখন ভারতে এ বিষয়টি নেই! তার মতো মানুষ কীভাবে এত বড় মিথ্যা কথা বললেন? এমিকাস কিউরিরা অনেক নিকৃষ্টমানের বক্তব্য দিয়েছেন।

তারা মানুষের সামনে মুখ দেখাবেন কীভাবে? তারা জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাদের নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তিনি এ সময় ভারতের সংবিধানে থাকা বিচারপতিদের অভিশংসনের বিধানটি তুলে ধরে বলেন, আসলে এরা সুবিধাবাদী।

যুক্তরাজ্য, ভারত, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সংবিধানেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে রয়েছে। একমাত্র পাকিস্তানের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দেয়া হয়েছে। আইয়ুব খানের প্রণীত সেই আইন আমাদের দেশের এমিকাস কিউরিদের পছন্দ! সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।

সেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত এই জাতীয় সংসদ। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে এই সংসদ ইমপিচমেন্ট করতে পারলে বিচারপতিদের পারবে না কেন? তিনি আইনমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানিয়ে বলেন,  দেশের সংবিধানের যদি কেউ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন, তিনি হলেন জিয়াউর রহমান।

শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ষোড়শ সংশোধনী কোনোভাবেই অবৈধ হতে পারে না, বরং অবৈধ বিষয়টিকেই পুনর্বহাল করে সংবিধান পরিপন্থি রায় দেয়া হয়েছে কি না সেটি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর থেকে অনেক বিচারপতি সংবিধান পরিপন্থি কাজ করেছেন। আপনারা কয়জন বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নিয়োগ দেন। সেই রাষ্ট্রপতিকে এই সংসদ ইমপিচমেন্ট করতে পারলে বিচারপতিদের পারবে না কেন? বাংলাদেশে আর কোনোদন অসাংবিধানিক শাসন আসবে না, তাই দিবাস্বপ্ন দেখে কারো লাভ নেই।

শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিচারপতিদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকতে হবে। আপনারা বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। কেন কি কারণে আপনারা এ ধরনের বক্তব্য দেন। এটাই তো সংবিধানের পরিপন্থি কাজ। যদি মনে করেন অসাংবিধানিকভাবে আবার কেউ ক্ষমতায় আসবে তাহলে সে স্বপ্ন আর দেইখেন না। ওটা আর হবে না। যে কেউ যে অপরাধ করেন না কেন তাদের বিচার হবে। ড. কামাল আর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম হচ্ছেন সুবিধাভোগী।

তিনি বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন, তবে সংসদ পর্যন্ত হাত লম্বা হতে পারে না বিচার বিভাগের। এই সংসদ যদি সর্বোচ্চ আদালতের কার্যকর বা গ্রহণ না করে তবে ওই রায় কখনই কার্যকর হবে না। বিচারপতি বা যে-ই হোক, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে অবশ্যই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমান বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি জারি করার সময় কোনো বিচারপতি তো কোনো কথা বলেননি। বরং জাতির পিতা হত্যার বিচার করতে ৮ জন বিচারপতি রাজি হননি। সর্বোচ্চ আদালত সেসব বিচারপতির বিরুদ্ধে কী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? তাই সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি অনুরোধ, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন, নিজেরাই তা পুনর্বহাল করুন।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই হচ্ছে আমাদের বাহাত্তরের মূল সংবিধান। এই সংবিধানকে অবজ্ঞা করার অধিকার কারও নেই। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করলেন, কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে কোথায় সাংঘর্ষিক তা আদালত স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

আলোচনার সূত্রপাত করে মাঈন উদ্দীন খান বাদল বলেন, আমরা বিচার বিভাগের বন্ধু। সারাজীবন আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। কিন্তু ইদানীং বিচার বিভাগ থেকে যেসব সিদ্ধান্ত আসছে তা অনভিপ্রেত। সংবিধানের ৯৬ ধারা বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু এই ধারা কোথায় মূল সংবিধানে কোথায় ধাক্কা দিয়েছে তা সর্বোচ্চ আদালতকে বলতে হবে। 

যেসব আইন জাতীয় সংসদ প্রণয়ন করে তা আপনারা (সুপ্রিম কোর্ট) সবগুলো কী বাতিল করতে পারেন? বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে যা ছিল, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে তা প্রতিস্থাপন করেছি মাত্র। এটা কীভাবে সংবিধান পরিপন্থি হয়? একজন বিচারক যদি অন্যায়-অপরাধ করে থাকেন তার বিচার কীভাবে হবে? আমরা তো সব বিচারকের বিচারের কথা বলিনি। 

আপনারা (সর্বোচ্চ আলাদত) রায় দিলেন সামরিক শাসন অবৈধ। অবৈধ হলে সামরিক শাসন আমলে প্রণীত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কীভাবে বৈধ হয়? রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ইমপিচমেন্ট হয় সংসদে, আর বিচারকরা নিজেদের বিচার নিজেদের হাতে নিয়েছেন। তাই রায় জনগণের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবেন- তা ভবিষ্যতের হাতেই তুলে দিলাম।

জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ড. কামাল হোসেন অনেকবার নিজের ভোল পাল্টেছেন। কালো টাকা সাদা করেছেন। তিনি কিভাবে এমিকাস কিউরি হতে পারেন? যখন এসব নিয়ে কথা বলা হয় তখনই ষড়যন্ত্র করা হয়। পৃথিবীর এমন কোনো গণতান্ত্রিক দেশ নেই যেখানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। তিনি বলেন, এই ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামরা বাহাত্তরের সংবিধানে যা করেছিলেন, ষোড়শ সংবিধানের মাধ্যমে তাই করা হয়েছে। কিন্তু কেন এখন তাঁরা বিরোধিতা করছেন? বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই আমরা বিশ্বাস করি। জাতীয় সংসদ সার্বভৌমত্বের প্রতীক।

আমরা আশা করি, সর্বোচ্চ আদালত রিভিউ করে ষোড়শ সংশোধনী পুনর্বহাল করে সংসদ, সংবিধান, গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের প্রতি সম্মান জানাবেন। আপনারা (সর্বোচ্চ আদালত) এতই শক্তিশালী যে, আপনাদের অন্যায়ের বিচার করা যাবে না?

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, লাখো শহীদের রক্তে লেখা এই সংবিধান। সবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারে কোনো হাত দেয়নি এই সংসদ। যদি প্রধান বিচারপতি গুরুতর অপরাধ করেন তবে তাঁর বিচার কে করবে? প্রত্যেকেরই জবাবদিহীতা থাকতে হবে। বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফেরত যেতেই ষোড়শ সংশোধনী সংসদে পাস করা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/আতা

Link copied!