অভিমত

নীরবে পাঠ করার নেপথ্যে

  • মাছুম বিল্লাহ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০১৯, ০৩:৫৬ পিএম
নীরবে পাঠ করার নেপথ্যে

ঢাকা : আমরা বই, পত্রিকা বা যে কোনো ধরনের শিক্ষাসামগ্রী শব্দ করে কিংবা নীরবে পড়ে থাকি। বিশেষ করে কম বয়সের শিক্ষার্থীরা জোরে জোরে পড়ে থাকে আর বয়স্করা সাধারণত নীরবে পড়েন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকে আমরা নীরবে পড়ার কিছু অংশ দেখতে পাই।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নীরব পাঠ শিক্ষার্থীদের একা পড়ার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। তাদের পাঠে অধিক মনোযোগী হতে সাহায্য করে। কোনো কিছু পাঠ করে তা থেকে মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য নীরব পাঠ প্রয়োজন।

চারদিকে যখন কোলাহল, তখন কোনো কিছু পাঠ করলে অনেক শিক্ষার্থীই তাতে মনোযোগ দিতে পারে না। নীরব পাঠ তাদের কোনো বিষয়বস্তুর ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ দান করে। তাই শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষার্থীদের শব্দ করে পড়ার পাশাপাশি মাঝে মাঝে নীরবে পড়তে দিতে হয়। যেমন পরীক্ষার ক’দিন আগের ক্লাসগুলোতে এ ধরনের পাঠ থাকলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয় পক্ষই সময়টুকু কাজে লাগাতে পারে।

শব্দ করে শিক্ষক যখন কোনো কিছু বোঝাচ্ছেন, দেখা যাবে ওই বিষয়টি বেশ কিছু শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে বেশ ভালো করেই বুঝেছে এবং পড়েছে। তখন তাদের কাছে শ্রেণিকক্ষে আসা সময় নষ্টের মতো মনে হয়। পরীক্ষার আগে শ্রেণিকক্ষে কোনো কিছু সশব্দে করা তাদের জন্য সময় নষ্ট হওয়া।

আর এটি তো প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, আমাদের শ্রেণিকক্ষগুলো ‘মিক্সড অ্যাবিলিটি’র শিক্ষার্থী দিয়ে ভর্তি থাকে। তাই সশব্দে সবসময়ই সবকিছু করা হলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক নাও হতে পারে।

শিক্ষার্থীরা যখন নীরবে কোনো কিছু পড়ে, তখন তারা যে বিষয়টি পড়ছে তাদের মনের মধ্যে তার একটি ছবি এঁকে ফেলে, ফলে সেই পাঠ এবং পাঠের বিষয়বস্তু দীর্ঘস্থায়ীভবে মনে স্থান পায়। ক্লাসে একজন শিক্ষক একইভাবে কোনো বিষয় লেকচারের মাধ্যমে বুঝিয়ে থাকেন যা একেক শিক্ষার্থী একেকভাবে বোঝে এবং বুঝতে সময় নেয়।

তাই যখন তারা নীরবে ওই বিষয়টি পড়ে, তখন তারা বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করতে পারে। আর যখনই সে গভীরে প্রবেশ করে, তখন সে নতুন এক ধরনের আনন্দ পায়, তার বোধগম্যতা বা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পায়।

কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে কোনো কিছু পড়ার যে দক্ষতা তা বৃদ্ধি করে এই নীরব পাঠ। এর কারণ হচ্ছে, পড়ার মূল ফোকাস থাকে তখন বিষয়বস্তুটি যাতে বোঝা যায় তার দিকে, শব্দের উচ্চারণের দিকে নয়, যেটি শব্দ করে মুখে পড়ার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

তা ছাড়া দ্রুত কোনো কিছু পড়ার ক্ষেত্রেও নীরব পাঠ আমাদের সাহায্য করে। বিভিন্ন শব্দের মধ্যে সম্পর্ক এবং সংযোগ স্থাপিত হয় এই নীরব পাঠের মাধ্যমে। আমরা যা কিছুই পড়ি তা হজম করতে এবং তথ্যের সন্নিবেশ ঘটাতে অর্থাৎ বিষয়বস্তুটি হ্রদয়ঙ্গম করতে কিছু সময় এবং কিছু নীরবতার দরকার, নীরব পাঠ আমাদের সে সুযোগটি করে দেয়।

কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা ক্লাসকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করেন এবং শিক্ষার্থীদের সুযোগ করে দেন, তারা যেসব বিষয় পড়েছে সেগুলো এক অপরের সঙ্গে আলোচনা করতে। আবার কিছু কিছু ক্লাসে শিক্ষক জুটিতে কাজ করতে দেন সেখানে একজন সহপাঠী অন্যজনের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে সে কোন বিষয়টি নীরবে পড়ে ফেলেছে এবং সেখান থেকে কী কী শিখেছে।

অর্থাৎ কোনো কিছু প্রথমে একটি নির্দিষ্ট সময় যাবৎ নীরবে পড়তে দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য বা আলোচনা করার জন্য এ ধরনের গ্রুপে কাজ করতে দিতে পারেন।

শব্দ করে কোনো কিছু পাঠ করা প্রথমদিকের ব্যাপার, এটি তখন গুরুত্বপূর্ণ। আর নীরব পাঠ জীবনব্যাপী উপকারী এবং প্রয়োজনীয়। উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নীরব পাঠই আমরা করে থাকি। এটি আসলে একটি দক্ষতা যা এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অর্জন করতেই হয় তবে এর প্র্যাকটিস শুরু করতে হয় মাধ্যমিক পর্যায় থেকে।

শিক্ষার্থীদের যখন নীরবে কোনো কিছু পাঠ করতে দেব, তখন আমরা শিক্ষক হিসেবে কী ভূমিকা পালন করব? আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে কোন শিক্ষার্থী কী করছে।

অনেক সময় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং অফিসের কর্মকর্তাদের অনেক জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। সেসব জটিল বিষয় মাথার মধ্যে ঢোকাতে তারা নীরব পাঠের আশ্রয় নেন। তার অর্থ কী? কোনো কিছুর গভীরে প্রবেশ করতে হলে নীরবে পাঠ করতে হয়।

বাস্তব জীবনে আমরা প্রাকৃতিকভাবেই নীরব পাঠক। আমরা যখন কফিশপে যাই, হোটেল-রেস্টুরেন্টে যাই তখন খাবার মেন্যু পছন্দ করি লিস্ট দেখে। সেই লিস্ট বা মেন্যু কি আমরা জোরে জোরে পড়ি?

আমরা পাবলিক পরিবহনে উঠে অনেক নিয়ম-কানুন ও আইনগত বিষয়াদি পড়ে থাকি, সেগুলো কীভাবে পড়ি? অবশ্যই নীরবে। কারণ আমরা আমাদের চারপাশের লোকদের বিরক্ত করতে চাই না, আর ভালোভাবে বোঝার জন্য আমরা নীরবে পড়াটাকেই শ্রেয় মনে করি। আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়ে থাকি, কীভাবে পড়ি? নীরবে পড়ি। সংবাদপত্র, গল্প, উপন্যাস- এগুলো আমরা নীরবে পড়ে থাকি।

আমরা মিশে যাই গল্পের ঘটনার সঙ্গে, উপন্যাসের নায়ক-নায়িকার সঙ্গে। তাদের ব্যথায় ব্যথিত হই, তাদের সুখে ও আনন্দে উৎফুল্ল হই, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উত্তেজিত হই, আমাদের রি-অ্যাকশন প্রকাশ করি। আমরা নীরবে পাঠ করি বলে বিষয়গুলোর গভীরে যেতে পারি এবং সেগুলোর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে পারি।

যে কোনো ধরনের পরীক্ষার কথা যদি মনে করি তাহলে আমরা কী দেখি? প্রশ্নপত্র সবাই নীরবে পাঠ করছে। পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র যদি সবাই জোরে জোরে পড়া শুরু করে তাহলে কী হবে? একটি বিরক্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেখানে কেউ আর পরীক্ষায় মনোনিবেশ করতে পারবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর এক রুমে দুই, তিন কিংবা চারজন করে শিক্ষার্থী থাকেন। একইরুমে তারা সবাই যদি জোরে শব্দ করে পড়েন তাহলে কী অবস্থা হবে? কেউই মনোযোগ সহকারে কিছু পড়তে পারবে না।

রুমের অবস্থাই তাদের নীরবে পড়তে বলে, বাধ্য করে। বাস্তব অবস্থা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বয়স সবকিছুই আমাদের নীরবে পড়তে বলে আর প্রকৃতিগতভাবে বেশিরভাগ পাঠই আমরা নীরবে করে থাকি। নীরব পাঠের অভ্যাস আমাদের মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই শুরু করি।

কীভাবে এটি কার্যকর করা যায়, শিক্ষক সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উপদেশ দেবেন এবং প্র্যাকটিস করাবেন। তবে উচ্চারণ শেখানোর জন্য অবশ্যই শব্দ করে অর্থাৎ জোরে জোরে কোনো কিছু পড়তে দিতে হবে, এটি অবশ্য প্রথমদিকের ব্যাপার। বয়স বাড়ার সঙ্গে এবং শিক্ষার উপরের সোপানে ওঠার সঙ্গে আমাদের পাঠাভ্যাসে যে পরিবর্তন দেখা দেয়, নীরব পাঠ তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

Link copied!