স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ ও সম্ভাবনা

খেকো না তাড়িয়ে খাতে ঢেলে লাভ নেই

  • এস এম সাব্বির খান | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২০, ০৫:০০ পিএম
খেকো না তাড়িয়ে খাতে ঢেলে লাভ নেই

ঢাকা : মুঠোফোনের আলাপচারিতায় হোক বা সরাসরি সাক্ষাতে; সাবলীল কথোপকথনের শুরুতেই আসে, 'কেমন আছেন? শরীর-স্বাস্থ্য ভাল তো? পরিবারের অন্যান্যরা সকলে কুশল-মঙ্গল..?' বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্যখাতের যে বেহাল চিত্র, চরম অব্যবস্থাপনা ও নানা কাজের সমন্বয়হীনতা, চলমান দুর্নীতি আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফলে সৃষ্ট বিপত্তি আর বিভ্রান্তি বিরাজমান, সে কথা বিবেচনা করে এই জিজ্ঞাসার বিপরীতে দুঃখ ভারাক্রান্ত চিত্তে বলতে হয়, "ভালো নেই। মোটেই ভালো নেই।"

চলমান করোনা পরিস্থিতির মাঝে একদিকে সরকার যখন দেশের কোটি মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা ও জীবন মান নিশ্চিতকরণে প্রতিটি পদে রীতিমত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সে সময় এই করোনা মহামারির বিরুদ্ধে নিষ্প্রভ স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্র। যার ফলে জনমানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সংক্রান্ত অনেক  গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রচেষ্টার সর্বোচ্চ অব্যাহত রেখেও সেভাবে সাফল্যের দেখা পায়নি সরকার। সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মাঝে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি, স্বাস্থ্য খাতের সীমাহীন দুর্নীতি, করোনাকালীন চিকিৎসা সেবায় নিবেদিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা উপকরণ যোগান দেয়া ও সহায়তা প্রদানসহ প্রতিটি পর্যায়ে বইতে হচ্ছে ব্যর্থতার বোঝা।

সামগ্রিক দিক বিবেবচনায় স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক পরিবর্তন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সদ্য ঘোষিত বাজেটের অধীনে নির্ধারণ করা হলো বিশাল বরাদ্দ। এই সংকটের মাঝেও স্বাস্থ্যখাতের সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে সরকারের দুঃসাহসী পদক্ষেপকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন বড় পীড়া দিচ্ছে- সরকার ও সংশ্লিষ্টজনেরা নানা দুর্ভোগ সয়ে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে বরাদ্দ দেবেন, বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনের কথা বলতেই তা মেটানোর অর্থ যোগান ও সহায়তা দেবেন আর পিণ্ডপুষ্ট করে তার সবকিছু ঘোঁপে গুজে দেবে খাতের খেকোরা। বরাদ্দও দেবে সরকার আবার এই করোনার মতো পরিস্থিতিতে নজিরবিহীন ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে মানুষের কাছে সমালোচিতও হবে সরকার, বারংবার কি তা মেনে নেয়া সম্ভব? সর্ব মহলে এ কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যে, খাতের বরাদ্দ যেটুকু সেটুকু তো প্রয়োগই করা হয়নি। তাহলে উন্নতি আসবে কি করে? আগে খাত খেকো তাড়াতে হবে। এরপর বরাদ্দের মুঠো দানেও সোনা ফলবে বলেই সকলের বিশ্বাস। নইলে যাই দেয়া হবে, যতই দেয়া হবে- শুধু খাতে যাবে আর খেকো খাবে।

বুধবার (১১ জুন) ২০২১-২০২২ অর্থবছরের নতুন বাজেট ঘোষিত হলো। কেউ বলছেন উচ্চাভিলাসী, কারো মতে অবাস্তব এক বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। আর একটি পক্ষ যে কী বলবে, তা বাজেট পরিকল্পনার আগে থেকেই জানা- 'জনস্বার্থ বিরোধী বিলাসী বাজেট'। আক্ষেপের বিষয় ঘোষিত বাজেটের প্রেক্ষাপটে যারাই এমনতর বিভিন্ন মন্তব্য ছুড়ে দিলেন, তারা মূলত একটি বিষয়ই তুলে ধরলেন- ক্ষেত্র, ইস্যু যাই হোক উনাদের মূল দায়িত্ব সরকারের বিরুদ্ধে বলা। সরকার যাই করুক সেটার বিচার, বিশ্লেষণ, অনুধাবন বা নিরক্ষণ নয়- শুধুই বিরোধী ও বিপরীত মন্তব্য।

স্বাস্থ্যখাতে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) এই খাতে বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট বক্তৃতায় এ প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য মতে, আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য মোট ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। কোভিট-১৯ এর সংক্রমণ মোকাবেলায় গৃহীত কার্যক্রমসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ খাতের জন্য এ বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ সংক্রান্ত কার্যক্রম ১৩টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে মোট বরাদ্দ ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ১.৩ শতাংশ এবং মোট বাজেট বরাদ্দের ৭.২ শতাংশ।

সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে আপনার এই সাহসী পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। আর তাই প্রত্যাশা, সাফল্যই আপনার চরণ চুম্বন করুক।

এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বারংবার ঘুরেফিরে সামনে আসছে, যেগুলো আমলে নেয়া অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা। প্রথমত, স্বাস্থ্যখাতের এই জীর্ণদশা দূরীকরণে অর্থ বরাদ্দের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হচ্ছে এই খাতের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যা দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, অতীত বরাদ্দে কমতি ছিল নাকি বরাদ্দ খাত শুদ্ধ গিলে খাওয়ার বুভুক্ষতা বর্তমান জরাগ্রস্ততার জন্যে দায়ী; তা পর্যবেক্ষণ করা। তৃতীয়ত, ব্যর্থ ও সমালোচিতদের বহাল রেখে এই বরাদ্দ থেকে কতটা উপযোগিতা পাওয়া সম্ভব তা খতিয়ে দেখা। চতুর্থত, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে চলমান সময়ে সরকার প্রধানসহ কেন্দ্রীয় পর্যায়ের প্রত্যক্ষ নজরদারী ও সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও সবকিছুকে বেপরোয়া উপেক্ষা করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও হটকারিতা অব্যাহত রাখার যে ধৃষ্টতা দেখা যাচ্ছে, সেসব ধৃষ্টাচারীদের মূল জীবনিশক্তির রসদ জুটছে কিসে তা খুঁজে বের করা এবং সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি ভোগান্তি সৃষ্টিকারী এই সিন্ডিকেট সমূলে উপড়ে ফেলা।

আমরা যদি বিগত সময়ের সকল অভিযোগ আপত্তি এক পাশে সরিয়ে রেখে শুধু এই করোনাকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে, সংকটের সূচনা থেকেই একের পর এক বিতর্কিত পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে অনেকাংশেই মানুষের অনাস্থায় পর্যবশিত হয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষায় প্রাথমিক পর্যায়ের গাফিলতি ও তথ্য সরবরাহে লুকোচুরি, প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা খ্যাত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মান সম্পন্ন স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, করোনা চিকিৎসার লখেত্রে হাসপাতালগুলোর অনুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে, হাসপাতালগুলোর উপর নজরদারি ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করন; এমন প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ স্বাস্থ্য বিভাগ।


বিভিন্ন সময় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা দেখেছি যে আমাদের একজন প্রধানমন্ত্রী, আমাদের এই একজন মাত্র অভিভাবক তার সর্বস্ব দিয়ে নিবেদিত লড়াইটা জিতে যাওয়ার। তিনি যখনই যা জানতে চেয়েছেন, তাকে জানানো হয়েছে মিথ্যা আর ভুল; যখনই কিছু নির্দেশ দিয়েছেন সম্মুখে 'জ্বি জ্বি' করে আড়ালে লুটে নিয়েছে সে কাজের বরাদ্দ, রীতিমত খাত শুদ্ধ। আর সত্য কেউ জানাতে চাইলে এসেছে বাধা।

আমি অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখি না। আমার অর্থযোগ কম, নিতান্ত মধ্যবিত্ত। এত মোটা অংকের হিসাবে চোখে ধাঁধা লাগে। আমি শুধু বলতে চাই- জনগনের কাজে লাগে, জনগণ পায়, জনগণ বইতে পারে, জনগণ চায়; এই ক্ষুদ্র পরিসর ধরে আপনাদের বিবেচ্য বিধানটুকুই ধার্য করুন। আর সরকারের প্রতি আমার ছোট্ট নিবেদন, স্বাস্থ্যখাত আজ ও আগামীর প্রতিটি দিনের জন্য আবশ্যক। শুধু করোনা নয় সর্বদা সহায়। খেকো তাড়ান। খেকো না তাড়িয়ে খাতে ঢেলে লাভ নেই। সরকারের উপর আমার অগাধ আস্থা। তাই আজো মুঠোফোনে হোক বা সরাসরি সাক্ষাতে, আমি কিন্তু সেই চিরাচরিত প্রশ্নের সাবলীল জবাবটাই দিয়ে যাচ্ছি, 'ভালো আছি, বেশ ভালো আছি'। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আমরা শুধু একটু ভালো থাকতে চাই। তা শুধু আপনিই দিতে পারেন।

লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

Link copied!