নারীর প্রতি বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধ হোক

  • জাওয়াদুল করিম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১, ১২:৪৭ পিএম
নারীর প্রতি বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধ হোক

ঢাকা : বর্ণবাদ সমাজ ও সভ্যতার এক ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গি, যার মাধ্যমে মানবজাতিকে বিভিন্ন উঁচু-নিচু শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। মানুষকে অবজ্ঞা করা, নীচ মনে করা মানে মানসিক অবক্ষয়ের পরিচয় দেওয়া। এটা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক। নিকৃষ্ট এই বিভাজনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রাধান্য পায়। গায়ের চামড়ার রং, পেশা, গোত্র, অঞ্চল ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বর্ণবাদের চর্চা করা হয়।

উগ্র এই মতবাদের পথচলা শুরু হয় আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলে। সর্বপ্রথম ১৬৫২ সালে রাইবিক নামক বণিকের নেতৃত্বে এক ডাচ অভিযাত্রী দল তাদের লম্বা সমুদ্রযাত্রার বিরতির জন্য আফ্রিকার কেপটাউন অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়। ধীরে ধীরে এ বণিক দল সেখানে খামার গড়ে তোলে এবং নিম্নমানের জীবনযাপন করা কৃষ্ণাঙ্গদের সেই খামারে নিয়োগ দেয়। ক্রমশ সেখানে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কালো চামড়ার মানুষদের এই শ্বেতাঙ্গ বণিক সম্প্রদায় ব্যবহারের পণ্য হিসেবে অধিক বিবেচনা করত। এভাবেই কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য শুরু হয় এবং বর্ণবাদের পথচলা শুরু হয়।

বর্তমান আধুনিক বিশ্বে প্রকাশ্যে বর্ণবাদের চর্চা হয় গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত আমেরিকায়। সেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সবখানে সাদা-কালো বৈষম্য সেটা ধারণা করা যায়। এজন্যই বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এটা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজের আদিপ্রবাহ ও আমাদের ইতিহাসে জঘন্যতম অধ্যায়।’ দাসপ্রথার ফলে আমেরিকায় সপ্তাদশ শতকে বর্ণবাদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটা এখনো বিদ্যমান আছে, তা ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েড হত্যা পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট অনুমেয়।

বাংলাদেশে বর্ণবাদ বিদ্যমান কি না বা এই সমস্যার গভীরতা কতটা তা নিয়ে অনুসন্ধান বা গবেষণা হয় না বললেই চলে। সাধারণ অর্থে বাংলাদেশে বর্ণবাদ নেই। গায়ের রঙের কারণে কাউকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে নাই। তবে বর্ণবাদ আছে সমাজ, পরিবার, বিজ্ঞাপনে। আমরা এক সময় শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা শোষিত হয়েছি। সে সময় থেকেই হয়তো বর্ণবাদের ধারণা আমাদের মননে, মস্তিষ্কে অঙ্কুরিত হয়। তা ছাড়া বর্তমানে আধুনিকতাকে আঁকড়ে ধরার প্রয়াসে পশ্চিমা সভ্যতা, সংস্কৃতির দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের জীবন প্রভাবিত। ফলে বর্ণবাদের রেশ এখনো আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত।

আমাদের সমাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্ণবাদের আগ্রাসনের শিকার হয় নারীরা। সমাজে মেয়েদের গাত্রবর্ণ নিয়ে বর্ণবাদ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। একটা মেয়ের গায়ের রং কালো হলেই বোধশক্তি হওয়ার পর থেকেই তাকে শুনতে হয় নানা তিরস্কার। তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সে সুশ্রী নয়। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ফরসা ত্বকেই বিদ্যমান আসল সৌন্দর্য। সমাজের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য কালো মেয়েটা হীনম্মন্যতায় ভোগে। সে ভাবতে পারে না, প্রকৃতিদত্ত গায়ের রঙের জন্য তার ওপর দিয়ে সমাজ সৌন্দর্যের বিভেদরেখা টেনে দেবে।

আচ্ছা, সৌন্দর্য বিচারের  প্রকৃত মাপকাঠি কী? সেটা কি শুধু ফরসা রঙের মাঝে সীমাবদ্ধ! নারীর সৌন্দর্য প্রকাশিত হবে তার চিন্তাশীলতা, বিচক্ষণতার, ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে। সেখানে ত্বকের রঙের মাধ্যমে সৌন্দর্যকে সংজ্ঞায়িত করা স্পষ্ট বর্ণবাদের পরিচয়।

বিয়ের সময় নারীকে আরেক দফায় বর্ণবাদের শিকার হতে হয়। পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফরসা মেয়েকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, কালো মেয়েকে উপেক্ষা করা হয়। একুশ শতকে এসেও গয়ের রং কালো হলে ‘মেয়ের বিয়ে কী করে হবে’ এই ভাবনায় বাবা-মাকে চিন্তাগ্রস্ত থাকতে হয়।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় সেখানেও বর্ণবাদের চিহ্ন দৃশ্যমান। এখন প্রায় সব পাত্র চাই বিজ্ঞাপনে শুরুতে বলা হয়, ‘সুশ্রী বা ফরসা পাত্রীর জন্য সুযোগ্য পাত্র চাই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কবেরী গায়েন ১৯৯৯ সালে চারটি পত্রিকায় প্রকাশিত ৪৪৬টা বিয়ের বিজ্ঞাপনের ওপর গবেষণা করেন। তার গবেষণালব্ধ ফল এমন ছিল, ‘বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে ২২০টি অর্থাৎ ৪৯.৩২ শতাংশ বিজ্ঞাপনে সরাসরি পাত্রীর গায়ের রং ফরসা উল্লেখ করা হয়। সুন্দরী, অসম্ভব সুন্দরী, রূপসী ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে ২২২টি বিজ্ঞাপনে। ১৩টি বিজ্ঞাপনে পাত্রীপক্ষ পাত্রীর শ্যামলা রঙের কথা উল্লেখ করেছেন।’

১৯৯৯ সালে এভাবে বিজ্ঞাপনে বর্ণবাদের ইঙ্গিত বিদ্যমান ছিল। বর্তমানের কথা ভাবুন! এ ধরনের সমস্যা তো  এখন আরো তীব্র। বর্ণবাদের সাথে পুঁজিবাদের সংমিশ্রণ হওয়ার ফলে চলমান এ সংকট পরিস্থিতি আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। ত্বক ফরসাকারী প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনগুলোতে বর্ণবাদের চিত্র স্পষ্ট দৃশ্যমান।

বহুল পরিচিত এক ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনের কথা সবার মনে থাকার কথা, যেখানে দেখানো হতো—ধীরে ধীরে ফরসা হওয়ার উপায়। ফরসা হলেই জীবন বদলে যাবে। কালো আত্মবিশ্বাসহীন মেয়েটি ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করে ফরসা হয়ে যায়। ফরসা হওয়ার সাথে সাথে মেয়েটা আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভর হয়ে ওঠে।

ফরসা হলেই কি মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে যাবে? কালো মেয়ে কি আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না! এভাবেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বর্ণবাদের মাধ্যমে বিষ আমাদের মননে, চিন্তায়, মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বর্ণবাদের এই কলুষিত ছোঁয়া থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত হতে কি পারবে আদৌ? হয়তো একদিন পারবে।

পরিবর্তন আসুক সমাজ ব্যবস্থায়, পরিবর্তন আসুক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে। সমাজ থেকে মুছে যাক মানব সভ্যতার এই কলঙ্কজনক অধ্যায়, এটাই কাম্য।

লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

Link copied!