পাটের সোনালি অতীত এবং অর্থনীতিতে নতুন গতি

  • অলোক আচার্য | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১, ০২:২৬ পিএম
পাটের সোনালি অতীত এবং অর্থনীতিতে নতুন গতি

ঢাকা : সুপ্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে অর্থকরী ফসল হিসেবে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি পাটকে। সোনা রঙের আঁশে কৃষকদের চোখে ছিল সোনার স্বপ্ন। পাটের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল রমরমা। জীবন ও জীবিকার প্রধান অনুষঙ্গ ছিল পাটকেন্দ্রিক। তাই পাঠ্য পুস্তকে পাটকে সোনালি আঁশ বলা হতো। সেই সোনালি আঁশের সুদিন আবার ফিরতে শুরু করেছে। পরপর দুই মৌসুমে পাটের দাম ভালোই পাচ্ছেন কৃষকরা। এতে তাদের মধ্যে পাট চাষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর টানা দুই বছর ধরে কৃষক পর্যায়ে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে পাট। পাট খাত ঘিরে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন প্রায় ১ কোটি চাষি। গত বছর পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ১০৩ কোটি ৫৭ লাখ (১.০৩ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। পাটের দাম এবং বিশ্ব বাজারে পাটের অবস্থান পাট নিয়ে অতীতের সোনালি দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্ববাজারে আমাদের পাটের চাহিদা আজো ব্যাপক। পাট এবং পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো। ব্রিটিশ আমল এবং তার পরবর্তীতেও বহু বছর পাটই ছিল আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল। এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজীকে বলা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি। এটা ছিল বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে স্থাপিত প্রথম পাটকল।

বাংলাদেশে পাটশিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে বাওয়া জুট মিলস লিমিটেড স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। তবে নানা কারণে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সরকারি পাটকল বন্ধ হলেও বেসরকারি খাতের প্রচেষ্টায় করোনাকালেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। বিগত অর্থবছরের তুলনায় পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, বস্ত্র ও পাটখাতে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন ঘটাতে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বন্ধ কারখানাগুলো পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর বন্ধ পাটকলগুলো চালু করে পাটপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব। পাটকলগুলো চালু হলে নতুন করে দেশে পাটের অগ্রযাত্রায় গতি লাভ করবে। বাংলাদেশের কাঁচাপাট রপ্তানি হয় প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভোরিকোষ্ট, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে। আর পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয় ইউরোপ, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, সিরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রে। কিন্তু অর্থনীতির গতি পরিবর্তন এবং দেশে পাটের পূর্বের সুনাম হারানোতে ধীরে ধীরে পাটের গুরত্ব কমতে থাকে। এর কারণ অবশ্য বহুমুখী।

পাটের তৈরি উৎপাদিত দ্রব্যের বিকল্প দ্রব্য বাজার দখল করা এবং সেই সাথে অর্থনীতিতে বিকল্প খাতের উত্তরণ। পাটের বিকল্প বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক আয় বাড়তে থাকে। বিপরীতে পাটের সাথে যাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল তাদের উৎসাহ কমতে থাকে। ফলে সেই অবস্থা ক্রমান্বয়ে জৌলুস হারাতে হারাতে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে সরকারসহ সবাই চাইছে পাটকে সেই সমৃদ্ধ অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ফলে নেয়া হয়েছে বহুমুখী পরিকল্পনা। এখন পাটের বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। পাটের বহুমুখী ব্যবহার আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিনিয়ত পাট থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের নতুন নতুন ব্যবহার আসছে। পাটের উন্নত জাত আবিষ্কৃত হয়েছে। চলছে গবেষণা। আমরা পাটের যে চিরাচরিত ব্যবহার জানতাম তার চেয়ে আরও বহুমুখী ব্যবহার আসছে। তার মধ্যে একটি হলো পাটের তৈরি পলিব্যাগ। সারা বিশ্বে আজ মাথাব্যথার কারণ হলো পলিথিন। বলা যায় আমাদের সভ্যতা ধ্বংসের পথে যাওয়ার পেছনে এটাকেও দায়ী করা হয়। পরিবেশবান্ধব এই পাটের তৈরি পলিব্যাগ এক মহাগুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। দেশের পাটশিল্প ও পরিবেশ রক্ষার সুবিধার্থে পাটের পলিব্যাগ উৎপাদন করে একদিকে যেমন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব, অন্যদিকে মানবজাতির বৃহৎ স্বার্থে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে। সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের প্রকল্প নিলে ঢাকা শহরসহ সারাদেশ উপকৃত হবে। কারণ পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগ পরিবেশ বান্ধব, পচনশীল ও সহজলভ্য। একটা কথা তো সত্যি, বহুদিন পলিথিন ব্যবহারের ফলে মানুষ যে অভ্যাসের দাস হয়েছে তার থেকে সহজে মুক্তি নেই। তাদের হাতে এমন এক পণ্য তুলে দিতে হবে যা হবে আজকের পলিথিনের মতোই। তাই সমাধান এই পাটের পলিব্যাগের মাধ্যমে। সুতরাং পাটের তৈরি সোনালী ব্যাগ সহজ এবং চমৎকার একটি সমাধান। এখন প্রয়োজন এটি বাজারে ক্ষতিকর পলিথিনের জায়গা দখল করার মতো উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ করা। যাতে সহজেই সবাই এটি ব্যবহার করতে পারে। এর কাঁচামাল আমাদের দেশীয়। ফলে একদিকে এই সোনালি ব্যাগ রপ্তানি করেও  বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। পাশাপাশি পলিথিন থৈরি করতে যে কাঁচামাল আমদানি করতে হয় তা বেঁচে যাবে। সেক্ষেত্রে দরকার সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ ও প্রয়াস।

নিজেদের আবিষ্কার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে। পাটের ব্যবহার আজ বহুমুখী। আর বহুমুখী হওয়ার কারণেই পাটের কদর বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, নার্সািরি পট, কুশন কভার, পর্দা ছাড়াও বহু ধরনের পণ্য পাট থেকেই তৈরি করা হচ্ছে। ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা এখন আগের তুলনায় পাট চাষে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। এখন শুধু লক্ষ রাখতে হবে যেন প্রান্তিক চাষিরা পাটের ন্যায্য মূল্য পায়। পাটের গুরুত্বপূর্ণ অনেক আবিষ্কারের মধ্যে একটি হলো পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব টিন তৈরি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী পাট দিয়ে এই পরিবেশবান্ধব টিন তৈরি করে চমকে দিয়েছেন। এই বিজ্ঞানীর আবিষ্কারই হলো  পাটের সোনালি ব্যাগ, জুটিন বা ঢেউটিন, হেলমেট ও টাইলস। পাট থেকে তৈরি জুটিন পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। এটা পাটের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার। পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষ পাটের বহুমুখীকরণের নানা উদ্যোগ নিয়েছে। পাটের সবুজ পাতা থেকে ‘চা’ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, যা সত্যিই চমৎকার। এটি এখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার পরিকল্পনাও হয়েছে। এ চায়ের ভেষজ গুণ থাকায় বিদেশে এর চাহিদাও রয়েছে। পাটের চা ডায়াবেটিস, হূদরোগ, কোলেস্টরলসহ বিভিন্ন রোগ ও জীবাণু সংক্রমণ রোধে বেশ কার্যকরী। ইতিমধ্যে তা রপ্তানি শুরুও হয়েছে। ফলে এর সম্ভাবনার দুয়ার নতুনভাবে খুলে গেছে। যে পাটকে বিশ্ব কেবল সুতা, বস্ত্র বা এ ধরনের চিরচেনা কিছু পণ্যে দেখতো তা আজ পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ এর বহুমুখীকরণ হয়েছে। এখন প্রয়োজন তা ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো এবং বিদেশে রপ্তানি শুরু করেছে। আমাদের দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু পাট চাষের জন্য উপযুক্ত হওয়ায় পাটের চাষে কৃষকের আগ্রহ ছিল ব্যপক। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো যখন পাটের তৈরি দ্রব্যের বিকল্প আবিষ্কার এবং সেই সাথে পাটের পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে পরা। ফলে এই সোনালি আঁশ চাষ করার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর ভাগ্য উন্নয়ন হয়নি। বর্তমানে কাঁচা পাট রপ্তানি করার সাথে সাথে পাটের তৈরি সুতা, কুণ্ডলী, পাটের বস্তা ও ব্যাগ, ম্যান মেইড ফিলামেন্ট এবং স্ট্যাপল ফাইবারস পাট ও পাটজাত পণ্য হিসেবে রপ্তানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় পাটের সুতা ও দড়ি। পাট দিয়ে তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে।

আগে যেসব পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার করা হতো না, সেসব পণ্যে আজ পাটের মোড়ক ব্যবহার করা হয়। এর পর থেকে এই খাতে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। এখন সারাবিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার হয়েছে। ফলে যেসব পণ্যে গত কয়েক দশক ধরে প্লাস্টিক ব্যবহার করার ফলে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানেও পাটের ব্যবহার আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের সঙ্গে দেশের বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা অতীতের মতো আজও নির্ভর করে। এই উত্তরণ আশা জাগায় যে, ক্রমেই দেশে পাটের সোনালি অতীত ফিরে আসবে এবং অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার ঘটবে।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected]

Link copied!