১৯৭২ সালের পর থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে যখন ক্রমবর্ধমানভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যু ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছিল, ঠিক তখনই প্রখ্যাত বাম রাজনীতিক ও সাংবাদিক নির্মল সেন প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, এমন একটি দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্যও প্রার্থনা করতে হবে কিনা? সেই সময় তিনি কলাম লিখেছিলেন “স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই”। এই স্লোগানটি শুধুমাত্র নির্মল সেনের ব্যক্তিগত উদ্বেগ ছিল না, বরং এটি সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও হতাশারও প্রতিচ্ছবি ছিল। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর, সদ্য গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসীবাদী সরকারের পতনের পর সারা দেশে ভিন্ন মতালম্বিদের আস্তানা, আখড়ায়, দরবারে হামলা, আগুন লাগানো, কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলার যে ঘটনা ঘটছে, তাতে আবারও নির্মল সেনের মত কেউ কি বলবে “লাশ ও কবরের নিরাপত্তা চাই”!
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে একটি মহল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর লক্ষ্যে অব্যাহত ষড়যন্ত্র করছে। বিশেষ করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়, ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পত্তির ওপর হামলা করে, কবর থেকে লাশ উঠিয়ে অগ্নি সংযোগের মাধ্যমে দেশে একটি নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। ফ্যাসীবাদের পতনের পর স্বৈরশাসকদের ইতিহাস মুছতে গিয়ে ছাত্র আন্দোলনের সফলতাকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রকারীরা ভাস্কর্য ভাঙতে গিয়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদ, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৭ বীরশ্রেষ্ঠকে মুছে দিতে চাচ্ছে। হেফাজতের নামে কেউ কেউ অতিউৎসাহী হয়ে রাজধানীর ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরে শহীদি চত্বর বানানোর চেষ্টা, দেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার ভাঙছে, জলের গানসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করেছে।
সর্বশেষ ভিন্ন মতগোষ্ঠীধারী ‘নুরাল পাগলা’ ও তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজবাড়ীতে যে ঘটনা ঘটল, তা সত্যিই নিন্দনীয়। এটি কোনো শুভ লক্ষণ নয়। যদিও নুরাল পাগলার কর্মকাণ্ড অনেকের কাছে সমর্থনযোগ্য নাও হতে পারে, তবু কবর থেকে তাঁর লাশ তুলে পুড়িয়ে দেওয়া কোনো ধর্ম বা সভ্যতার সমর্থনযোগ্য কাজ নয়। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে মৃতদেহের অসম্মান করা গুরুতর অপরাধ।
সরকার অবশ্য নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এ ধরনের ঘটনা বরদাশত করা হবে না। তবে প্রশ্ন হলো, সরকারের কাজ কি শুধু বিবৃতি দেওয়া? নাকি এই নৃশংস ঘটনা যাতে না ঘটে, তার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা? নুরাল পাগলার কবরে যে আঘাত হানা হবে, এমন আভাস পূর্বেই দিয়েছিল ‘তৌহিদী জনতা’। তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? পুলিশ অদূরেই অবস্থান করছিল, প্রয়োজনবোধে তারা সেনাবাহিনীও ডাকতে পারত। কিন্তু মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্যান্য স্থানে যেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তেমনি এখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল একেবারেই নির্লিপ্ত।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিছিল প্রথমে নুরুল হকের আস্তানার ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে দরবারের লোকজন ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। পরে অন্য পাশ থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। একপর্যায়ে কয়েকশ লোক দেয়াল টপকে ভিতরে ঢুকে দরবারে হামলা চালায়। এই সময় ভক্তদের কয়েকজনকে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে নুরুল হকের লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পদ্মার মোড় এলাকায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশত লোক আহত হন।
যারা এই নৃশংস ঘটনায় জড়িত, তাদের আসল উদ্দেশ্য কি শুধুই নুরাল পাগলার উপর ক্ষোভ, নাকি অন্য কিছু? নাকি তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে অন্য কোন শক্তির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে? সরকারের উপদেষ্টাদের নীরবতার কারণে হামলাকারীরা উৎসাহিত হচ্ছে। ফ্যাসীবাদী শাসকের পরতনের পরপরই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে, আরও ঘটার আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ইসলামে মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ঈমানের অংশ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কোনো মৃতদেহের হাড় ভেঙে ফেলা জীবিত অবস্থায় ভাঙার মতোই গুনাহ।” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৬১৬)। মুসলিম হোক বা অমুসলিম, কারো লাশ অপমান করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
রাজবাড়ির ঘটনা মানুষের মানবিক হৃদয়কে বিদীর্ণ করেছে। কবর থেকে লাশ তুলে এনে সেটি পুড়িয়ে ফেলা কেবল আইনবহির্ভূত নয়, এটি ইসলামী শরীয়ত, মানবতা এবং সভ্যতার পরিপন্থী এক ভয়ঙ্কর অমানবিকতা। এমন ঘটনার দায় শুধু হামলাকারীদের নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও। সচেতন সমাজ নিরব থাকলে চরমপন্থী ও উগ্রবাদীরা সুযোগ নেবে, আর রাষ্ট্রের ব্যর্থতা তখন আরও স্পষ্ট হবে।
গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পতনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা সৃষ্টি হয়। কিন্তু সারা দেশে রাতারাতি এক শ্রেণির সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী ও অসাধুচক্রের আবির্ভাব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অর্জিত বিজয়কে অক্ষুন্ন রাখতে প্রতিটি গ্রাম-মহল্লায় দলমত নির্বিশেষে জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে।
বাংলাদেশে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা থাকবে, মাজার থাকবে, বাউল ও ফকিরসহ সমস্ত সংস্কৃতি থাকবে। এই দেশ সব ধর্মের, সব জাতির, সব মানুষের দেশ।
ঔপনিবেশিক কাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কেউ কখনও মাজার ভাঙেনি। এবার ঘোষণা দিয়ে আক্রমণ হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার হামলা হয়েছে এবং শাহপরাণে হামলায় একজনকে মেরে ফেলা হয়েছে। এসব হামলার পেছনে ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক দ্বন্দ্ব-বিতর্কের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বার্থপর শক্তি যুক্ত থাকতে পারে। সরকারের উপদেষ্টাদের দুর্বলতা ও উপরের চাপের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
মানুষের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করতে না পারাটা অধর্মের অংশ। রাজবাড়ির ঘটনা সাধারণ নয়; এটি ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক বিবেক ও রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার ওপর কঠিন প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। জনমনে প্রশ্ন জাগছে—“হায়রে বাংলাদেশ! মুসলমান মুসলমানের লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দিচ্ছে! এ কোন দেশের দিকে যাচ্ছে আমরা?”
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :