যে কারণে স্বাস্থ্যসেবায় অংশীদারিত্ব জরুরি

  • সাকিফ শামীম | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৫, ০৫:৩৯ পিএম
যে কারণে স্বাস্থ্যসেবায় অংশীদারিত্ব জরুরি

ফাইল ছবি

জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার স্বাস্থ্যচাহিদা এবং সীমিত সরকারি সম্পদের প্রেক্ষাপটে এককভাবে সরকারের পক্ষে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব অর্থাৎ পিপিপি মডেলকে কার্যকর কৌশল হিসেবে দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম। তাঁর মতে, এই অংশীদারিত্বকে ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নয়, বাস্তব ডেটা, নীতি এবং কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

জাতীয় স্বাস্থ্য হিসাবের তথ্য বলছে, দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশই জনগণকে নিজ পকেট থেকে বহন করতে হয়। এটি নির্দেশ করে যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার আর্থিক সুরক্ষা এখনো দুর্বল। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের প্রায় ৬২ শতাংশই সেবা নেন বেসরকারি খাত থেকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, নিবন্ধিত বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে ১৫ হাজার ২৩৩টি, যা ক্রমে বাড়ছে। এই বাস্তবতা দেখায় যে বেসরকারি খাত এখন দেশের স্বাস্থ্যসেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সরকারি খাতের পরিপূরক শক্তি।

এই প্রেক্ষাপটে একটি কাঠামোগত ও সমন্বিত পিপিপি মডেল প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি। সরকারি খাতের অব্যবহৃত বা স্বল্প ব্যবহৃত অবকাঠামো, উচ্চমূল্যের চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি বেসরকারি অংশীদারদের ব্যবস্থাপনায় এনে জনগণের জন্য সহজলভ্য করা যেতে পারে। এতে সরকারি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাশিক্ষা বিস্তারের জন্য বিদেশি যৌথ উদ্যোগে মেডিকেল কলেজ স্থাপন করাও জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক পিপিপিকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের কার্যকর কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে এই অংশীদারিত্ব সাধারণত তিন ধরনের মডেলে পরিচালিত হয়-সেবা পরিচালনা, অর্থায়ন এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য হাসপাতাল নির্মাণে বেসরকারি অর্থায়নের মডেল সফলভাবে ব্যবহার করেছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত ও থাইল্যান্ড এই মডেলকে স্বাস্থ্যখাতে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছে। ভারতে বিভিন্ন রাজ্য বিশেষ করে রোগ নির্ণয় ও জটিল সার্জারির ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের প্রযুক্তি সরকারি হাসপাতালে যুক্ত করে সেবার মান বাড়িয়েছে এবং অপেক্ষার সময় কমিয়েছে। থাইল্যান্ড তার সফল স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাঠামোর মাধ্যমে সরকারি অর্থায়ন ব্যবহার করে বেসরকারি হাসপাতালকে চুক্তির আওতায় এনে সেবা বিস্তৃত করেছে। সেখানে সেবার মূল্য ও মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।

ভারত ও থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশও বেশ কয়েকটি কৌশলগত উন্নতি আনতে পারে। থাইল্যান্ডের মতো সরকারি অর্থায়নে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্দিষ্ট প্যাকেজ সেবা চালু করা হলে খরচ কমবে এবং সেবার মান বাড়বে। ভারতের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে বিশেষায়িত রোগ নির্ণয়, জটিল সার্জারি বা নবজাতক সেবা উন্নয়নে বেসরকারি খাতের দক্ষতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে চুক্তিতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে; সেবা মান না মানলে জরিমানার মতো ধারা যুক্ত করতে হবে।

কার্যকর পিপিপি মডেল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী সুশাসন ও ডেটাভিত্তিক নজরদারি। চুক্তিতে সেবার মূল্য, মান ও জনগণের প্রবেশাধিকার স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী কাঠামো তৈরি জরুরি। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদারকি ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে একটি স্বাধীন স্বাস্থ্যসেবা রেগুলেটরি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন সাকিফ শামীম। এই কমিশন সেবার মূল্য নির্ধারণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও অভিযোগ নিষ্পত্তিতে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে।

জনস্বার্থ রক্ষায় চুক্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিকে আরও বিস্তৃত করে পিপিপি কাঠামোর আওতায় আনলে জনগণের নিজ পকেটের ব্যয় কমবে। স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ থাকা উচিত, যা সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্বকে আরও কার্যকর করবে।

মেডিকেল যন্ত্রপাতি উৎপাদনেও দেশকে আত্মনির্ভর হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন সাকিফ শামীম। বর্তমানে ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রায় সবই আমদানি করতে হয়। সরকারি জমিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তায় মেডিকেল যন্ত্র প্রস্তুতকারক কারখানা স্থাপন করা গেলে ব্যয় কমবে এবং স্বাস্থ্যখাতে বৈদেশিক মুদ্রার চাপও হ্রাস পাবে।

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সক্ষমতা বাড়ানোও জরুরি। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের উদ্যোগে মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী হবে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করাও সহজ হবে।

স্বাস্থ্যসেবায় সবার জন্য মান নিশ্চিত করতে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারিত্ব আর বিকল্প নয়, বরং একটি জাতীয় অগ্রাধিকার। অবকাঠামো বা যন্ত্রপাতির চুক্তির বাইরে গিয়ে সেবার মান ও জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এই অংশীদারিত্ব চালু করতে হবে। সঠিক ডেটা, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ও সমন্বিত নীতির মাধ্যমে এই মডেল কার্যকর হলে ২০৩৩ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতের বাজার ২৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনও সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান ও জনগণের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কার্যকর পিপিপি বাস্তবায়নই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

সাকিফ শামীম, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক 
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার।

এসএইচ 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Link copied!