মোকতাদির চৌধুরী হেরে গেলে হারবে বাংলাদেশ!

  • হাসান শান্তনু | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০১৬, ০৩:০৯ পিএম
মোকতাদির চৌধুরী হেরে গেলে হারবে বাংলাদেশ!

দুটি প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ যেমন প্রায় শতভাগ নিশ্চিত, তেমনই একটি প্রশ্নের উত্তরে লজ্জামিশ্রিত ‘না’ নিশ্চিত। প্রথম দুটি প্রশ্নের মধ্যে একটি হচ্ছে- কলেমা বা মন্ত্রপড়া নতুন বউ বাসরঘরে লম্বা ঘোমটা টেনে লজ্জাবনত হয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকাকালে জানতে চাইলে- ‘তুমি আমাকে দেনমোহর মাফ করেছো কী না।’

দ্বিতীয় প্রশ্নটি যে কোনেও সরকারের আমলে বিটিভির প্রতিবেদকের। দর্শকের মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে ‘এ সরকারের আমলে আপনি ভালো আছেন তো’ জিজ্ঞেস করলে।

তিন নম্বর প্রশ্নটি কোনও কোনও সাংবাদিককে (ঢালাওভাবে বলার সুযোগ নেই) করেন তাঁদের সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক ‘সূত্রের’ বিষয়ে। সূত্রের নাম বলা যাবে কী না-এমন প্রশ্নের উত্তরে সাংবাদিক অবশ্যই বলবেন-‘না’। কারণ, কথিত প্রতিবেদনে সাংবাদিক যে ‘সূত্রের’ কথা উল্লেখ করেন, তা আসলে সূত্র নয়, পাঠকরা শব্দটিকে পড়তে পারেন ‘মূত্র’ হিসেবে। 

ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য স্বার্থান্বেষী মহলের দেয়া তথ্যে ‘সাংবাদিক’ প্রতিবেদন করলেও ওই মহলের কাউকে নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদকের কাছে যে দাবি করা যাবে না, এটা তিনি বা তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন।

কথিত সূত্র দিয়ে ১৯৯৭ সালে দৈনিক দিনকাল প্রখ্যাত, প্রয়াত সাংবাদিক নির্মল সেন, এবিএম মূসা, যায়যায়দিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শফিক রেহমানসহ প্রায় ষাটজনের বিরুদ্ধে একটা ‘প্রতিবেদন’ ছাপায়। 

তাতে দাবি করা হয়, ওই সাংবাদিকরা নাকি প্রতি মাস শেষে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন থেকে পাঁচ-সাত হাজার টাকা নেন ভারতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার দালালির বিনিময়ে! 'প্রতিবেদনটি' যে অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয় নষ্ট রাজনৈতিক পল্লির সূত্র থেকে, তা প্রমাণ হতে বেশিদিন লাগেনি। 

অপশক্তির এক সূত্রের বরাতে প্রকাশনা বন্ধ থাকা দৈনিক আমার দেশ ‘প্রতিবেদন’ ছাপায়, কাবার গিলাফ বদলানোকে একাত্তরের নারী ঘাতক, জামায়াতি মওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর মুক্তির পক্ষে কাবার ইমামের নেতৃত্বে মানববন্ধন বলে! মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের নানা সময় এসব ‘খবর’ ছাপানোর তালিকাটা এখন বেশ লম্বা হয়েছে। 

অবশ্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমের বেলায়ই এটা সত্য, তাদের কোনও কোনও সাংবাদিক ডাহা মিথ্যের এজেন্টকে ‘সূত্র’ হিসেবে প্রতিবেদন করায় পরে তা ভুয়া প্রমাণিত হয়। এর জন্য কখনও কখনও সংবাদমাধ্যমকেও কড়া মাশুল দিতে হয়েছে।

ভয়ালগোষ্ঠীর দেয়া বিকৃত, অসত্য তথ্যকে ভিত্তি করে ‘সূত্রের’ বরাদ দিয়ে সম্প্রতি ঢাকার কয়েকটা প্রচারমাধ্যমে সংবাদ ছাপানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর-৩ আসনের সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

একই ব্যক্তির লেখা (মূলত লিখেছেন কে?) এসব সংবাদে দাবি করা হয়, ৩০ অক্টোবর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে নাকি মোকতাদির চৌধুরীর সমর্থকরা জড়িত!

রাজনৈতিক দলে এক নেতার অন্য নেতার বিরুদ্ধে ঈর্ষা কাতরতা থাকতে পারে। এটা গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের নতুন ক্রেতা কোনও দেশের রাজনৈতিক দলের বেলায়-ও সত্য। আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা কেউ মোকতাদির চৌধুরীর প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে কথিত ওই সূত্রকে মদদ দিচ্ছেন না, এমন কথা জোর দিয়ে বলা ঠিক হবে না। 

প্রতিহিংসা, ঈর্ষা কাতরতা থেকে কেউ মোকতাদিরের মতো অসাম্প্রদায়িক, পরিচ্ছন্নতার পথিকৃৎ রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে কিছু বললে, তা সংবাদ হয় কিভাবে? এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে মাত্র একটি ‘সূত্রের’ কাছ থেকে ‘তথ্য’ পেয়ে প্রতিবেদন করা নিঃসন্দেহে নিচু মানের সাংবাদিকতা। অথচ এরই শিকার হলেন বিশিষ্ট লেখক, পাক্ষিক মত ও পথের সম্পাদক মোকতাদির চৌধুরী।

এক সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাদপীঠ বলা হতো  ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে। রাষ্ট্রপিতা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে হত্যার পর থেকে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কালো ছোবলে আক্রান্ত হয় ওই জেলা। 

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কবলে। মৌলবাদের আঁতুরঘর হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া এ জেলাকে আগের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নেয়ার লড়াইটা ’৯৬ সালে মোকতাদির চৌধুরীই শুরু করেন। তখনও জেলা আওয়ামী লীগের কোনও কোনও নেতা উগ্রবাদের কাছে আপসকামিতায় নানা সুবিধা ভোগ করেন বলে অভিযোগ আছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পুরনো, নিজস্ব চেহারায় ফিরিয়ে নেয়ার সংগ্রাম শুরু করার পর শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা শত্রু পক্ষের বাধার সম্মুখীন হননি মোকতাদির, নিজ দলেরও কোনও কোনও নেতার কাছ থেকে তিনি তীব্র সমালোচনার শিকার হন। তবে পিছু হটেননি। এ সংগ্রামের জন্য তাঁকে গত চারদলের জোট সরকারের আমলে চরম রোষানলে পড়তে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে তখন মামলা দায়েরের অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু করেন আলাল, দুলাল, ফালু, লালু, ভুলু, দুলুদের রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। 

বিএনপির নেতৃত্বে চারদলের জোট সরকারে একাত্তরের দানব জামায়াতসহ ধর্মব্যবসায়ী ফজলুল হক আমিনীর (তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়) দলও ছিল। সরকার গঠনের পর থেকেই শুরু হয় একাত্তরের কায়দায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দু, খ্রিষ্টান, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতন। তাঁদের মন্দির, গির্জা, উপাসনালয়ে বোমাবাজির উৎসবে মেতে ওঠে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ধর্মান্ধ শক্তি। 

এদের ধারাবাহিক আর পরিকল্পনামাফিক তাণ্ডব, অত্যাচার, খুন, হত্যা, ধর্ষণের ফলে অনেক সংখ্যালঘু পরিবার তখন দেশ ছেড়ে সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মোকতাদির চৌধুরীর ওপর তখন চলছিল প্রশাসনকে ব্যবহার করে জোট সরকারের নির্মমতা। ওই অবস্থাতেও তিনি সংখ্যালঘু পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদেরকে দেশ না ছাড়তে সাহস জুগিয়েছেন।

প্রগতিশীলতার মশাল হাতে ২০১১ সালে সদর আসনের সাংসদ হন স্বপ্নবাজ পুরুষ, সাবেক ছাত্রনেতা মোকতাদির। জেলার অবকাঠামোগত প্রকৃত উন্নয়ন শুরু হয় ’৯৬ সালে। এর সূচনাও মোকতাদির চৌধুরীর হাত ধরেই। আর এর জন্যই তাঁকে বলা হয় আধুনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রূপকার। দেশের অন্যতম বিখ্যাত কবি আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁকে অভিষিক্ত করেন- ‘তিতাস জনপদে রবিউল একটি নদীর নাম।’

অন্যায়, অবিচার, জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মোকতাদির যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ লড়াইয়ে বার বার তিনি বিভিন্ন বাধার মোকাবেলা করেছেন সাহসের সঙ্গে। এবারও তাই করবেন বলে মনে করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সব শ্রেণি, পেশা, ধর্মের মানুষ। 

জেলার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়মিত দেশ-বিদেশের বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে নানা সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজনও করছেন তিনি। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের মানবিক বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর বিশেষ স্নেহাসিক্ত এ রাজনীতিক।

যে অপশক্তির বিরুদ্ধে মোকতাদির চৌধুরী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, আজ সেই অপশক্তি তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার। এরা জানে, ওই জনপদ থেকে মোকতাদিরকে দূরে সরাতে না পারলে এদের ভোগের রাজনীতি অচল সিকির মতো থাকবে, চলবে না। 

তবে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে মানুষকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা সম্ভব হলেও এরা জয়ী হতে পারবে না। শাসক দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোকতাদিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সরকারের শীর্ষ মহল অবগত, এটা প্রভাবশালী তিন মন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ আরও অনেকের বক্তব্যে স্পষ্ট। তাঁরা বলেছেন, কোনো গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নাসিরনগরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালিয়েছে, এমন আভাস পেয়েছে সরকার। 

শিরা, উপশিরায় আপসকামিতার বিষ মিশে থাকা রাজনীতিক, আমলা; পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার দালালরা খেলারাম হলে মোকতাদিরের মতো অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মনের রাজনীতিবিদকেই বেছে নেন খেলার জন্য। আমরা জানি, মোকতাদির সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে গেলে সব অর্থে হারবে আওয়ামী লীগ! 

উগ্রগোষ্ঠীর কাছে এ রাজনৈতিক দল পরাজিত হলে হারবে শহীদদের রক্তস্নাত এ বাংলাদেশ। দেশটাকে একাত্তরে হায়েনামুক্ত করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূল আর অশুভগোষ্ঠীর মোকাবেলা করে উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন তাঁরই তনয়া শেখ হাসিনার সাহসে সাহসী।

হাসান শান্তনু: সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক। 
[email protected]

মোকতাদির চৌধুরীর শত্রুপক্ষ আ.লীগের ‌‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ হয় কীভাবে?

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Link copied!