ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদীর ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলার পর থেকে তার জামিনপ্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়া নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মামলার নথি ও হাইকার্টের আদেশ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গুরুতর সহিংস অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জামিনের সময়, মেয়াদ ও দ্রুততার বিষয়গুলো স্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির সময় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন ফয়সাল করিম মাসুদ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় একটি অফিসে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের হয় এবং একাধিক মূলধারার গণমাধ্যমে তার ছবি ও পরিচয় প্রকাশিত হয়।
গ্রেপ্তারের পর ফয়সাল করিমের জামিনের জন্য হাইকার্টে আবেদন করেন অ্যাডভোকেট কায়সার কামাল ও অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি এসকে তাহসিন আলীর বেঞ্চ তাকে ছয় মাসের জামিন দেন। আদালতের নথি অনুযায়ী, ওই দিন আদেশ দেওয়ার পর আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ১৯ ফেব্রুয়ারি আদেশটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। সাধারণত আদেশ প্রস্তুত ও আপলোডে সময় লাগলেও এই ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি তুলনামূলকভাবে দ্রুত সম্পন্ন হয়েছে বলে নথিতে দেখা যায়।
এরপর চলতি বছরের ১২ আগস্ট জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পুনরায় আবেদন করা হলে বিচারপতি মোহাম্মদ আলী ও বিচারপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ সুমনের বেঞ্চ নতুন করে এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন। ফলে অস্ত্র আইনের মামলায় গ্রেপ্তারের পর এক দফা ছয় মাস এবং পরবর্তী দফায় এক বছরের জামিন পান ফয়সাল করিম মাসুদ। হাইকার্টের এই দুটি আদেশের কপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে।
এই জামিন প্রক্রিয়া নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান দ্য ডিসেন্ট তথ্য প্রকাশ করে। শনিবার দ্য ডিসেন্ট তাদের ফেসবুক পেজে ফয়সালের জামিনসংক্রান্ত দুটি ডকুমেন্ট যুক্ত করে দাবি করে, গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জামিনের ধারাবাহিকতা ও সময়সীমা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দ্য ডিসেন্টের অনুসন্ধানে আরও বলা হয়, গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে ফয়সাল করিম মাসুদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিভিন্ন তথ্য ও চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিলেছে।
দ্য ডিসেন্টের দাবি অনুযায়ী, শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করা সন্দেহভাজন ব্যক্তি গত ৯ ডিসেম্বর ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং হাদির পাশেই বসে আলোচনাও শুনছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য অনুযায়ী, ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের সিসিটিভি ফুটেজ, পুলিশের সংগৃহীত হামলার সিসিটিভি ফুটেজ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি এবং ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে থাকা ফয়সাল করিম মাসুদ নামের অ্যাকাউন্টসহ আওয়ামীপন্থি বিভিন্ন পেজে থাকা ৫০টির বেশি ছবি তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করে তারা এই দাবি করেছে।
অনুসন্ধানে আরও উল্লেখ করা হয়, তিনটি আলাদা ঘটনায় সামনে আসা ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান নামের একজনের মিল পাওয়া গেছে। তিনি রাজধানীর আদাবর থানা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন বলে পুরোনো সংবাদে উল্লেখ রয়েছে। বিশেষভাবে নজর কেড়েছে গুলিবর্ষণকারী ব্যক্তির বাম হাতে থাকা একটি বিশেষ ডিজাইনের ঘড়ি। একই ডিজাইনের ঘড়ি পরা একাধিক ছবি ফয়সাল করিমের ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক প্রোফাইলে পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে দ্য ডিসেন্ট।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনাগুলো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকেই। শাকিল আহমেদ নামের এক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন, যারা অপরাধীদের জামিন করিয়েছেন এবং যারা জামিন দিয়েছেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত। তার ভাষায়, টাকার কাছে বিচার ব্যবস্থা বিক্রি হয়ে গেলে অপরাধীরা নিশ্চিত থাকে, অপরাধ করেও তারা পার পেয়ে যাবে।
এই প্রতিক্রিয়া একক নয়। গুলিবর্ষণ ও ডাকাতির মতো সহিংস অপরাধের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ মেয়াদের জামিন পাওয়ার ঘটনা আইনের চোখে সবার সমতার প্রশ্নে নতুন করে সন্দেহ তৈরি করেছে। আইনগতভাবে হাইকার্টের আদেশ বৈধ হলেও, ফয়সাল করিম মাসুদের মামলায় জামিনের সময়কাল, ধারাবাহিকতা ও দ্রুততার বিষয়গুলো আবারও আলোচনায় এনেছে-গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে জামিন নীতিমালা কতটা কঠোরভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
এসএইচ
আপনার মতামত লিখুন :