ঈদকে ঘিরে রাজধানীতে যানজট

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২২, ১২:৫৮ পিএম
ঈদকে ঘিরে রাজধানীতে যানজট

ঢাকা : আগামী ১০ জুলাই সারা দেশে উদ্যাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। এই ঈদকে ঘিরে রাজধানীতে দুটি স্থায়ীসহ মোট ২১টি পশুর হাট বসছে। যেখানে চাঁদ রাত পর্যন্ত চলবে কোরবানির পশু কেনাবেচা। পাশাপাশি বিভিন্ন মার্কেট এবং বাস, লঞ্চ ও ট্রেন টার্মিনালেও বাড়ছে মানুষের ভিড়।

ইতোমধ্যে মার্কেটে সাধারণ মানুষের আনাগোনা বেড়েছে, যা অব্যাহত থাকবে চাঁদরাত পর্যন্ত। ফলে পশুর হাট, বিভিন্ন টার্মিনাল ও শপিংমল-মার্কেটকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আগামী কয়েকদিন যানজট আরো বাড়বে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঈদ উদ্যাপনের বাকি ছয়দিন। ফলে এখন থেকেই রাজধানীতে গাড়ির চাপ বাড়তে শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও কোরবানির হাটগুলোতে বেচাকেনা পুরোপুরি শুরু হলে যানজট বাড়বে।

প্রতি কোরবানির ঈদেই ঢাকায় প্রবেশ ও বহির্গমনমুখে মানুষ ও পশুবাহী গাড়ির অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। এজন্য এখন থেকেই হাইওয়ে পুলিশ, মহানগর ও সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ এবং সড়ক বিভাগের দায়িত্বশীলরা কার্যকর ভূমিকা পালন না করলে যানজট ছড়িয়ে পড়বে পুরো রাজধানীতে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো ইতিমধ্যে ঢাকায় প্রবেশ ও বহির্গমন পথে আসন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করেছে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের স্রোত না কমালে ঢাকার প্রবেশ ও বহির্গমন এবং মহাসড়কে যানজট থাকবে। রোজার ঈদে শুধু ঢাকা থেকে বের হওয়ার সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকে। এ সময় ঢাকায় প্রবেশমুখে গাড়ির চাপ কম থাকে। কিন্তু কোরবানির ঈদে দুপাশে প্রচণ্ড গাড়ির চাপ থাকে। প্রবেশমুখে হাজার হাজার পশুবাহী গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করে। আর বহির্গমনমুখে হাজার হাজার গাড়িতে মানুষ ঈদ উদ্যাপন করতে ঢাকা ছেড়ে যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার প্রধান প্রবেশ ও বহির্গমনমুখের মধ্যে অন্যতম গাবতলী, টঙ্গী ও যাত্রাবাড়ী। এছাড়া পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বাবুবাজার, বছিলা এবং মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার করে ঢাকায় যাতায়াত বেড়েছে। ঢাকার প্রবেশ ও বহির্গমনমুখগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো সবসময়ই কিছু না কিছু কাজ করছে। কখনো সড়ক প্রশস্ততার কাজ করছে, কখনো সড়ক সংস্কার কাজ।

জানা গেছে, গাবতলী ও টঙ্গী ব্রিজের আধুনিকায়নের কাজ চলমান রয়েছে। টঙ্গী প্রবেশমুখে বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণকাজ চলছে। প্রতিবছর দুই ঈদ ও ব্যস্ততম সময়ে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ মাড়াতে হচ্ছে। আয়তনের তুলনায় ঢাকায় মানুষের বসবাস কয়েকগুণ বেশি হয়ে গেছে। তাই প্রায় প্রতিদিনই যানজট লাগছে।

গতকাল রোববার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে যানজট দেখা গেছে। একদিকে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। অন্যদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে রাস্তায় মানুষের উপস্থিত বেড়ে যাওয়ায় এই যানজট সৃষ্টি হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, রাজারবাগ, মতিঝিল ও যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কে যানজট দেখা গেছে। অফিস টাইমে এসব সড়কে ঘণ্টার বেশি সময় ধরে মানুষকে যানজটে বসে থাকতে হয়েছে বিভিন্ন যানবাহনে।

তবে এর মধ্যে সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারে। সকাল ৮টা থেকে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে ও ওপরে যানবাহনের জটলার সৃষ্টি হয়। যা দুপুর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এর ফলে অফিসগামী মানুষকে পড়তে হয়ে চরম বিপাকে। দীর্ঘক্ষণ যানজটে আটকে থাকার পর অনেককে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতেও দেখা যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর হানিফ ফ্লাইওভারে গাড়ির চাপ বেড়েছে মাওয়াগামী যানবাহনের কারণে। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসবে ততই যানজট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরে বাসে যানজটে আটকে থাকা যাত্রী করিম খান বলেন, এখন প্রতিনিয়ত ফ্লাইওভারের ওপরে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্লাইওভারে আটকে গেলে হেঁটেও পার হওয়া যায় না। তাই যানজট শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্লাইওভারেই বসে থাকতে হয়।

এদিকে এখনো রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটগুলোতে কেনাবেচা শুরু হয়নি। তবে হাটে কিছু ক্রেতা আসছেন এবং কোরবানির পশু দেখে চলে যাচ্ছেন। তবে রাজধানীর কোরবানি হাটে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাকে করে পশু আসা শুরু করেছে। ফলে হাট এলাকাগুলোতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

এ বিষয়ে হাটসংশ্লিষ্ট এলাকায় দায়িত্ব ট্রাফিক সার্জেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন অল্প ট্রাক আসছে কোরবানি পশু নিয়ে। তাই হালকা যানজট হচ্ছে। এছাড়া হাটে ক্রেতাদের উপস্থিতিও নেই বললেই চলে। তাই এখন পর্যন্ত যানজট পরিস্থিতি অনুকূলে রয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, দুই একদিনের মধ্যে হাটকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হবে তারা বলছেন, দুই একদিনের মধ্যে হাটে পুরোদমে বেচাকেনা শুরু হবে। এছাড়া প্রতিদিন হাটে ট্রাকে ট্রাকে পশু আসতে থাকবে। অন্যদিকে হাটে বাড়বে ক্রেতাদের উপস্থিতিও। ফলে সবমিলিয়ে বিগত বছরগুলোর মতোই দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হবে।

ঈদকেন্দ্রিক যানজট নিয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে উত্তরাগামী রাইদা পরিবহনের বাসের চালক রফিক মিয়া বলেন, আর দুয়েক দিন কিছুটা শান্তিতে গাড়ি চালাতে পারব। কোরবানির হাট শুরু হলে রামপুরা থেকে কুড়িল পর্যন্ত তিনটি হাট বসবে। আফতাবনগর হাট, সাঈদ নগর হাট ও ৩০০ ফিট কোরবানির পশুর হাটের কারণে রামপুরা থেকে কুড়িল পর্যন্ত রাস্তায় তীব্র যানজট থাকবে। যা ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত চলবে। তবে এসময় যানজট থাকলেও মনে আনন্দ থাকে। কারণ সবাই কোরবানির গরু-খাসি নিয়ে যায় রাস্তা দিয়ে, তা দেখতে ভালো লাগে।

যানজট পরিস্থিতি নিয়ে ডিএমপির ট্রাফিক গুলশান বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. ইমরান হোসেন বলেন, এ এলাকায় এখন পর্যন্ত যানজট স্বাভাবিক রয়েছে। এখনো কোরবানির ঈদকেন্দ্রিক যানজট শুরু হয়নি। আরো কয়েকদিন পর রাস্তায় গাড়ির চাপ বাড়বে যখন কোরবানির পশুর হাটগুলো পুরোদমে চালু হবে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আমরা সবসময় সচেষ্ট রয়েছি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ঢাকা নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকায় প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ হাজার মানুষ ঢাকায় বসবাসের জন্য আসছে। আদর্শ জনঘনত্ব অনুযায়ী রাজধানীতে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ মানুষের বসবাস করার কথা। কিন্তু সবকিছু কেন্দ্রীয়করণ করার কারণে ঢাকায় ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ বসবাস করছে।

পেশাজীবীরা জনঘনত্ব কমানোর পরামর্শ দিলেও সরকার সবকিছু কেন্দ্রীয়করণ করায় সেসব পরামর্শ কাজে আসছে না। প্রতিনিয়তই ঢাকামুখী জনস্রোত বাড়ছে। আর ঢাকার বর্তমান পরিবহনের গড় গতি অন্তত ৭ কিলোমিটার। পরিকল্পিত শহরে সড়ক থাকার কথা ২৫ ভাগ।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ঈদের সময় ঢাকার প্রবেশ ও বহির্গমনমুখে গাড়ির চাপ বাড়ে। তখন তীব্র যানজট হয়। এটা অনেকদিন ধরে চলে আসছে। দ্রততম সময়ে এর কোনো সমাধান দেখছি না। সবকিছু এভাবে চলতে থাকলে এমন ভোগান্তি মেনে নিয়েই চলতে হবে।

তিনি বলেন, ঢাকার প্রবেশ ও বহির্গমনমুখ প্রশস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু ঢাকার ভেতরের সড়ক প্রশস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ঢাকার প্রবেশমুখ প্রশস্ত করেও লাভ হচ্ছে না।

ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক মহাপরিচালক ড. এএসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, ঢাকার প্রবেশ ও বহির্গমনমুখের যানজট নিরসনে প্রবেশমুখে দুই লেনের সড়কগুলো চার লেন করে দেওয়া যেতে পারে। আর ঢাকার বৃত্তাকার সড়কব্যবস্থা গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ঢাকার জনসংখ্যা কমাতে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন না করলে ঢাকা এবং আশপাশের এলাকার যানজট নিরসন হবে না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!