রাজধানীতে কর্মহীন বস্তিবাসীদের হাহাকার

বাঁচলে বাঁচুম, মরলে মরুম

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ৩, ২০২০, ১১:৫৩ পিএম
বাঁচলে বাঁচুম, মরলে মরুম

ঢাকা : রাজধানীর কারওয়ানবাজার রেললাইন বস্তির ছোট্ট খুপরি ঘরে স্বামী ও ৩ সন্তানকে নিয়ে থাকেন গার্মেন্টকর্মী রহিমা। স্বামী শাহজাহান মিয়া ঝালমুড়ি বিক্রেতা। করোনায় লকডাউনের কারণে তারা হয়ে পড়েছেন কর্মহীন। সবাই ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে বসে আছেন। বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) কথা হয় রহিমার সঙ্গে।

বলেন, জামানো যে টাকা ছিল তা দিয়ে গত এক সপ্তাহ পার করেছি। সামনে কী খাব, কীভাবে চলব সেটা আল্লাহ পাকই জানেন। সরকার থেকে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সহায়তা করেনি। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন তারা। তা দিয়ে কোনোমতে দিন পার করছেন।

শাহজাহান মিয়া বলেন, প্রতিদিন ঝালমুড়ি বিক্রি করে যে আয় হতো তা দিয়ে ভালোই চলত তাদের সংসার। গত সপ্তাহে ঝালমুড়ি নিয়ে বের হলেও কোনো বেচাকেনা না থাকায় ফিরে আসেন। তিনি বলেন, বাইরে লোক সমাগম নেই। সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক ভর করছে।

ছোট্ট ঘরে এভাবে গাদাগাদি করে থাকলে করোনার ঝুঁকি আছে বলতেই রহিমা বলেন, ‘আমাদের তো আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। গ্রামেও বাড়িঘর নেই। তাই এখানেই এভাবে থাকতে হচ্ছে। বাঁচলে বাঁচুম, মরলে মরুম। কিছুই করার নেই।’   

শুধু কারওয়ানবাজার রেলওয়ে বস্তিই নয়, সরকারের অঘোষিত লকডাউনের পর করোনা ভাইরাস সংক্রমণে উচ্চঝুঁকিতে থাকা অধিকাংশ বস্তির চিত্রই এমন। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে কেউ কেউ তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এলেও অধিকাংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিই অতি দরিদ্র এসব বস্তিবাসীর পাশে দাঁড়াননি। অথচ কদিন আগেও ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত এসব বস্তির মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন তারা ভোটের জন্য। তাদেরই ভোটে হয়েছেন জনপ্রতিনিধি।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর শ্রমজীবী মানুষের একটি অংশ শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে। কিন্তু রাজধানীর বস্তিবাসীদের অনেকেরই নিজের বলতে ঘর-বাড়ি নেই। তাই তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই; কর্মহীন অবস্থায় তারা বস্তিতেই আছেন। ভাইরাসের আতঙ্ক থাকলেও তাদের কাছে করোনা প্রতিরোধের চেয়ে বেশি প্রয়োজন খাবারের নিশ্চয়তা। রাজধানীর সবচেয়ে বড় ও ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি কড়াইল বস্তি। করোনা আতঙ্কে এই বস্তির অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেছে। আর যারা আছে তারা কর্মহীন। ঘরে বসে তাদের অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

কড়াইলের ১ নম্বর ইউনিটের উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মাওলানা আবদুস সোবহান জানান, কিছু এনজিও ত্রাণসামগ্রী দিয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় সেটা অপর্যাপ্ত।

তিনি বলেন, বস্তির ঘরগুলো অনেক ছোট। এখানে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বস্তির মানুষের কাছে ভাইরাস প্রতিরোধের চেয়ে খাবার বেশি দরকারি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুর রহমান জানান, তার নির্বাচনী এলাকার বড় একটি অংশজুড়ে রয়েছে কড়াইল বস্তি। এখানে প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের বসবাস। পুরো বস্তিটি ৯০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে। এখানে সীমিত আকারে ত্রাণ সহায়তা শুরু হয়েছে।

গত ১১ মার্চ মিরপুরের রূপনগর বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যায় সহস্রাধিক ঘর। রাস্তায় নেমে আসে প্রায় ৪ হাজার মানুষ। এদেরই একটি অংশ আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষে।

গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বস্তিবাসীর অধিকাংশেরই নেই করোনা প্রতিরোধের হ্যান্ডগ্লাভস ও মাক্স। সরকারের পক্ষ থেকে করোনা ঠেকাতে হোম কোয়ারেন্টিনসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এর কোনো কিছুই নজরে আসেনি এই বস্তিতে।

এখানকার বাসিন্দা আইয়ুব আলী, গার্মেন্টকর্মী রহিমা, ভিক্ষুক রাশিদা, রিকশাচালক ফারুকসহ উপস্থিত অর্ধশতাধিক মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগুন আমাদের সব কেড়ে নিছে। এখানে এসে আশ্রয় নেওয়ার পর শুরু হলো লকডাউন। সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আমাদের সাহায্য করেনি। এখন আমরা কী খাব? দ্রুত খাবারের ব্যবস্থা করা না হলে করোনায় না মরলেও ভাতের অভাবে আমরা মারা পড়ব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনার তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫টি। বস্তিবাসী ও ভাসমান খানা রয়েছে ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১টি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬টি। এ শুমারিতে বস্তিবাসীর সংখ্যা ৬ লাখ উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বস্তিবাসীকে বাদ দিয়েই কাজ করা হচ্ছে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাদের জন্য এখনো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ সাধারণের চেয়ে বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এসব মানুষকে সুরক্ষার আওতায় আনতে হলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, করোনা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য যে ন্যূনতম শিক্ষা প্রয়োজন, তা বস্তিবাসীর নেই।

আবার গণমাধ্যমগুলোয় করোনা ভাইরাসের জন্য প্রচারিত সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন যে বস্তিবাসীর মধ্যে সবাই দেখেন, এমন নয়। এখনো বস্তিবাসীকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি এনজিও সংস্থাগুলো।

আশঙ্কাজনক হলেও এটি সত্য, বস্তিবাসীর মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিলেও তারা এ ভাইরাস পরীক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে ফোন দেবেন না। আবার বস্তিবাসীর নমুনা সংগ্রহ করতে কেউ বস্তিতেও যাবেন না।

এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই বস্তিগুলোয় গিয়ে কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কি না তা দেখতে হবে। প্রয়োজনে আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে আনতে হবে। বিষয়টি এখন জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!