জিকে শামীম সিন্ডিকেটের সেই প্রকৌশলীরা এখনও বহাল তবিয়তে

  • নিজস্ব প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২০, ০৭:০৬ পিএম
জিকে শামীম সিন্ডিকেটের সেই প্রকৌশলীরা এখনও বহাল তবিয়তে

ফাইল ছবি

ঢাকা : গণপূর্ত অধিদপ্তর দেশের একটি সুপ্রাচীন প্রকৌশল সংস্থা। দীর্ঘদিন ধরে কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কারণে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে গণপূর্ত প্রকৌশল অধিদপ্তর। অনেক প্রকৌশলীর নামে একের পর অভিযোগ জমা হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়। তবুও থেমে নেই গণপূর্তের দুর্নীতি-অনিয়ম ও সিন্ডিকেট বাণিজ্য।

গণপূর্ত অধিদপ্তরকে দীর্ঘদিন যাবত কুক্ষিগত করে রেখেছিলো মাফিয়া ঠিকাদার, ক্যাসিনো সম্রাট গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জিকে শামীম ও তার সহযোগীরা। জি কে শামীমের নেতৃত্বে গড়ে তোলা সিন্ডিকেট নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা।

বহুল আলোচিত ক্যাসিনো অভিযান শুরুর পর গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতন এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় গণপূর্ত সিন্ডিকেটের প্রধান জি কে শামীম। জি কে শামীম গ্রেফতারের পরই বেরিয়ে আসে তার ঘনিষ্ঠ সহোযোগিদের নাম। এরপর গণপূর্ত অধিদপ্তরের সেই সময়ের অতিরিক্ত প্রকৌশলী, তত্ত্বাধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ১৩ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। 

অভিযোগ উঠেছে, জি কে শামীম বর্তমানে জেলে থাকলেও তার ঘনিষ্ঠ নেই সব সহযোগীরা ও চিহ্নিত সেই সব প্রকৌশলীরা এখনও গণপূর্তে সক্রিয়ভাবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জি কে শামীম সিন্ডেকেটের অন্যতম সদস্য অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসেলহ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম সোহরাওয়ার্দী ও নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ্সহ অনেকেই এখনো সক্রিয়ভাবেই তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

শুধু তাই নয়, সিন্ডিকেটের এসব প্রকৌশলীরা প্রভাব খাটিয়ে স্বপদে বহাল থেকেও আলোচিত জি কে শামীমের ঘটনায় তাদের  দায়মুক্তির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিভিন্ন তথ্য প্রমাণসহ দুর্নীতি দমন কমিশনে একের পর এক তাদের নামে বিভিন্ন অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এত অভিযোগের পরেও তদন্তের পর কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

দুদক ও গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রভাশালীদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে বড় বড় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া নিয়ে অনিয়ম ও সরকারী অর্থ আত্মসাতসহ নানা অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসেলহ উদ্দিন আহমেদকে তলব করে ছিল দুদক। এরপর দুদক কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজিরও হয়েছিলেন তিনি। মূলত জি কে শামীম গ্রেফতারের পর তার সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে নাম আসে মোসেলহ উদ্দিন আহমেদের।
 
২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর  গণপূর্ত অধিদপ্তর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের পক্ষে সোহেল রানা নামের একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ দুদক প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দেয়। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বরও দুদকে একই ধরনের অভিযোগ দায়ের করেছেন মো. বদরুদ্দীন ওমর নামের আরেক ব্যক্তি। তিনিও  অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা রকমের অভিযোগ দিয়েছেন।
 
সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর আবারও নানা রকমের অভিযোগ তুলে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দাখিল করেছেন গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির পক্ষে মো. মোশাররফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি।

ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, “গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন আহম্মেদের অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গণপূর্তের সকল ঠিকাদার ব্যবসায়ী। পুরো অধিদপ্তরে তার পরিচিতি রয়েছে 'ফিফটিন পার্সেন্ট' নামে। বর্তমানে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এই হারে কমিশন নিয়ে থাকেন তিনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও গণপূর্তমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির কোনো তোয়াক্কা করেন না মোসলেহ উদ্দিন আহম্মেদ।”

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, “২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ভবনে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোসলেহ উদ্দিন আহম্মেদ। সেই সময় নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারি টাকা খরচ করে আলোচিত হন। তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে এবং সংসদীয় কমিটির তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পরে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) সিন্ডিকেটের অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিত এই মোসলেহ উদ্দিন।”

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, “বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে সংসদ ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব পালন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করা মোসলেহ উদ্দিন তার ব্যক্তি জীবনে গড়েছেন অঢেল সম্পদের পাহাড়। ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় কিনেছেন আলিশান বাড়ি, ঢাকা ও কুমিল্লায় একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল গাড়ি এবং বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে তার।এছাড়া গত অক্টোবরে চট্টগ্রাম গণপূর্ত জোন থেকে তিন কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা গণপূর্ত জোনে বদলি হয়ে আসেন মোসলেহ উদ্দিন।” 

বিসিএস ১৫তম ব্যাচের প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন ১৯৯৫ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। এরপর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকা শেরেবাংলা নগরে দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর শেরেবাংলা নগর ও দীর্ঘ সময় প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে সমন্বয় বিভাগে ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চট্টগাম জোনেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ওই সকল জায়গাতেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগে বলা হয়েছে, অষ্টম জাতীয় সংসদে অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি গণপূর্ত বিভাগের তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছি।

সোনালীনিউজ/এএস/এমএএইচ

Link copied!