হাওরবাসী: যাদের চোখে জল নেই!

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২৪, ২০১৭, ১২:৪৩ পিএম
হাওরবাসী: যাদের চোখে জল নেই!

ঢাকা : হাওরের দুঃখ কোথায়? মানুষের ব্যবহারে। সখিনার দুঃখ কোথায়? বুকের গহীনে। এই দুই দুঃখ বুকে নিয়ে বেঁচে আছে হাওর পাড়ের পাঁচ লাখ ৯৫ হাজার ৩০০ কৃষক পরিবার। এবার তারা সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব। সুনামগঞ্জের বৃহত্তম বোরো ধানের হাওরটিও তলিয়ে গেছে রোববার।

শনির হাওরটি তলিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সুনামগঞ্জের সবকটি হাওরই এখন পানির নিচে। সুবেহ সাদেকের আলো তখনো স্পর্শ করেনি। ভেঙে পড়ল সাহেবনগরের লালুখালি আর জলখালি বাঁধ। ফসল রক্ষা বাঁধে টানা ২৪দিন স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করার পরও শেষ রক্ষা হলো না। সুনামগঞ্জের খাদ্য ভা-ার হিসেবে খ্যাত শনির হাওরটি তলিয়ে যেতে শুরু করল।

নাগরিক নিরাপত্তার কাজে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অনেক জায়গায় দেখা গেলেও বানভাসি প্রায় ছয় লাখ কৃষক পরিবারের পাশে তাদের কাউকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি।

হাওর পাড়ের নোয়ানগর গ্রামের কৃষক আবদুল কাদির ডুবে যাওয়া সন্তানদের দিকে তাকিয়ে বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আল্লায় আমারে কেনে পাইন্নে ভাসাইয়া নেয় না! বাড়িত গিয়া বাচ্চা-কাচ্চারে (ছেলে-মেয়েদের ) কিতা খানি দিতাম।’ এ কান্না শুধু আবদুল কাদিরের নয়। শনির হাওর পাড়ের বারুঙ্কা, লোহাচুরা, আনোয়ারপুর, চিকসা, বীরনগর, জয়নগর, ধুমতা, উজান তাহিরপুর, মধ্য তাহিরপুর, নোয়ানগর, সাহেবনগর, বসন্তপুর, পাঁচগাঁওসহ ৫০টিরও বেশি গ্রামের হতভাগ্য মানুষের। যার সঙ্গে কথা বলেছি, বোবাকান্না ছাড়া আর কোনো প্রত্যুত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বলেছেন, সাহেবনগরের পূবপাশের বাঁধ ও জালখালি বাঁধটি পাউবো সময় মতো মূল বাঁধ তিন ফুট উঁচু করে দেওয়ার ব্যবস্থা নিলে আজ আর এ দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হত না। হাওর পাড়ের কৃষকদের নিয়ে বিরতিহীন ২৫ দিন কাজ করেও রক্ষা করা গেল না ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল।

তিনি আরো বলেছেন, হাওর তলিয়ে যাওয়ার দায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এড়াতে পারবে না কিছুতেই। একই কথা বলেছেন গ্রামের অনেকেই। তাদের মতে, সরকারের দীর্ঘ সময়ের উদাসীনতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ধারাবাহিক দুর্নীতির ফলে আজ তারা মরতে বসেছেন।

তারা আরো বলেছেন, এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। তবে পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, বাঁধ ভেঙে হাওরের মানুষের দুর্গতির পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, বর্তমান বিপদে এ থেকে শিক্ষা নেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। তবে এখান থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে, তা বলেননি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

প্রথমে বানের জলে ভেসে গেল ধান। সরকারি হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। কৃষকের মাথায় ঋণের বোঝাসহ সুদের চাপ। এলাকায় গবাদিপশুর খাদ্য সঙ্কট। অনেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে উজানে আত্মীয়স্বজনের কাছে গবাদিপশুসহ আশ্রিত।

অপরদিকে, হাওর এলাকা থেকে দলে দলে লোক গ্রাম ছাড়ছেন কাজের সন্ধানে। যাদের এখন গোলা থেকে ধান বিক্রি করে আয়েশ করার কথা, সেখানে প্রায় দুই কোটি হাওরবাসী পড়ে গেলেন সারা বছরের খাদ্য সংকটে। চারপাশে শুধু দুঃস্বপ্ন আর দুর্ভাবনার মহামারি। এমনটিই আজ বিপর্যস্ত হাওরের বাস্তব চিত্র।

এদিকে, রোববার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, হাওরের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়নি যে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হবে। অনেকেই মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি, বিশেষ করে হাওর পাড়ের মানুষ। তারা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবি উত্থাপন করেছেন। এত কিছুর পরও হাওর থেকে একটি সুসংবাদ পাওয়া গেছে।

সংবাদে বলা হয়, সুনামগঞ্জে হাওরের পানিতে তেজস্ক্রিয়তার যে মাত্রা পাওয়া গেছে তা বিপজ্জনক নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি দল। এলাকা পরিদর্শন এবং হাওরের পানি পরীক্ষার পর কমিশনের সদস্য দিলীপ কুমার সাহা গতকাল রোবরার এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্বাভাবিকভাবে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা থাকার কথা, এখানে তার চেয়েও অনেক কম রয়েছে।

এদিকে, হাকালুকি হাওরের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আ. ক. ম. শফিকুজ্জামান বলেছেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হাকালুকি হাওরের কৃষি জমির ধান গাছ পচে সৃষ্ট বিষক্রিয়ায় হাওরের পানির অক্সিজেন ও পিএইচ কমে যায় এবং এমোনিয়া বৃদ্ধি পায়। ফলে, গত ১৫ এপ্রিলের ঝড়ের পরদিন জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত হাকালুকি হাওরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মৃত দেখা যেতে থাকে।

বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশে ১৭ এপ্রিল থেকে একযোগে তিন উপজেলা হতে তিন লাখ টাকার চুন হাওরে ফেলা হয়। হাওর পার্শ্ববর্তী স্থানে মাইকিং করে মরা মাছ খাওয়া ও মাছ ধরা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। চুন ফেলার দিন হাওরের পানিতে পিএইচ- ৬, ডিও- ৪.৯ পিপিএম এবং এমোনিয়া ১ পিপিএম থাকলেও, পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে পিএইচ এবং ডিও বৃদ্ধি ও এমোনিয়া কমতে থাকে।

কথায় আছে, ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’। শেষ অব্দি এসেও এখনো হাওরবাসীর জন্য কোনো সুখবর নেই। যে সময় হাওর পাড়ের অসহায় মানুষের পাশে সকলের দাঁড়ানোর কথা তখন তা হয়নি। অসহায় কৃষকদের এমন দুর্বিপাকের মধ্যেই খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘হাওরে প্রায় প্রতিবছর এরকম ফসল ডুবি হয়।

এবার একটু বেশি হয়েছে। তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব।’ ৩০ লাখ টন ফসলহানির ক্ষতি তিনি কিভাবে পোষাবেন তা দেশবাসী জানে না। গায়ে-গতরে খেটে এই কৃষককুলকেই তা সম্ভব করতে হবে।

সোনালীনিউজ/জেডআরসি/এমটিআই

 

Link copied!