দিন দিন আগ্রহ হারাচ্ছেন যাত্রীরা

বেহাল দশা বিআরটিসি বাস সার্ভিসের

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০১৮, ০৯:১৬ পিএম
বেহাল দশা বিআরটিসি বাস সার্ভিসের

ঢাকা : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস সার্ভিসের বেহাল দশায় আগ্রহ হারাচ্ছেন যাত্রীরা। একমাত্র রাষ্ট্রীয় এ পরিবহন সংস্থাটির ভাঙাচোরা ও লক্কড়ঝক্কড় দুই শতাধিক বাস দিয়ে রাজধানীতে চলছে নামমাত্র যাত্রীসেবা।

মতিঝিল থেকে মিরপুর, মিরপুর থেকে গুলশান-বাড্ডা, মতিঝিল থেকে উত্তরা ও বনানী এবং পূর্বাচল ৩০০ ফিট সড়কে চলাচল করা এসি ও নন-এসি বিআরটিসি বাসের অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা বাধ্য হয়েই চড়ছেন বিআরটিসি বাসে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই বাহনে যাতায়াতে যাত্রীদের আগ্রহ থাকলেও বাসের দুর্দশায় সে আগ্রহে ভাটা পড়ছে যাত্রীদের।  

অন্যদিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে রাস্তায় নামা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও ওয়াইফাইসমৃদ্ধ ডিজিটাল বাস সার্ভিস চলছে ধুঁকে ধুঁকে। সড়কে জ্যামে আটকে থেকে যাত্রীরা যাতে ইন্টারনেট চালাতে পারেন, এমন ভাবনা থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিলে চালু হয়েছিল এ ব্যবস্থা।

মতিঝিল থেকে উত্তরার পথে বিআরটিসির ১৫টি এসি বাসে বসানো হয়েছিল রাউটার, ছিল বিনামূল্যে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সংযোগ। আর এ সুবিধায় যাত্রীরা যানজটে স্মার্টফোন-ট্যাব বা ল্যাপটপে ইচ্ছামতো সময় কাটাতে পারতেন। কিন্তু দুই বছর ধরে সেই বাসগুলো জোড়াতালি দিয়ে চললেও গত চার মাস থেকে চলছে না ইন্টারনেট তরঙ্গ। দু-চারটি বাসে খুব ধীরগতির ইন্টারনেট নিয়ে ওয়াইফাই রাউটার সচল থাকলেও, তা দিয়ে কোনো কাজ করা যায় না বলে অভিযোগ এই বাসের যাত্রীদের।

অনেক যাত্রী সরাসরি অভিযোগ করেন, ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা দেওয়ার কথা বলে বিআরটিসি আমাদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করছে। এদিকে মতিঝিল থেকে আবদুল­াহপুর রুটে চলাচলরত এসি বাসের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব বাসেও কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না যাত্রীরা। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন বিআরটিসি বাস সার্ভিসের ব্যাপারে নানা অভিযোগ পাওয়া যায় যাত্রীদের কাছ থেকে।

বিআরটিসি বাসের নিয়মিত যাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা তানবিরুল ইসলাম বলেন, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দীর্ঘপথে বাসে ইন্টারনেট সুবিধা যাত্রীদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল। শুরুর দিকে গতি ধীর হলেও বিরক্ত হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। এরপর এমন ধীর হলো যে ব্যবহারই করা যাচ্ছিল না। কিন্তু আজকাল আর এ সেবাটির দেখাও নেই। তা ছাড়া এসব বাসে বেশিরভাগ সময়ই এসি নষ্ট থাকে।  

বাসযাত্রী আমিনুল ইসলাম বলেন, বিআরটিসি বাসের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বডিতে জোড়াতালির কারণে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। বসার সিটের অবস্থাও খুব করুণ। অনেক বাসে ফোম ছাড়া চেয়ার স্থাপন করায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে শরীর ব্যথা করে। অন্য এক যাত্রী শিক্ষার্থী মামুন হোসেন বলেন, ধুঁকে ধুঁকে চলছে বিআরটিসি বাস। বাসগুলোর ভেতরের অবস্থা যেমন খারাপ, তেমনি বাইরের অবস্থাও। অনেক বাসের গ্লাস নেই, এতে বৃষ্টির পানিতে ভিজে হেলপারদের ব্যবহারও খুব খারাপ।  

বাসের চালকরা জানান, এসি বাস সার্ভিসের কোনোটিতে রাউটার থাকলেও, ইন্টারনেট রিফিলের অভাবে অচল হয়ে আছে। কোনোটিতে আবার রাউটারই নেই। বেশ কয়েকটির রাউটার থেকেও নষ্ট। তা ছাড়া বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ বাসগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করে না। আমারা সমস্যার কথা বার বার জানালেও তা সমাধানের উদ্যোগ নেয় না ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ফলে বাধ্য হয়ে এভাবেই রাস্তায় বাসগুলো চালাতে হচ্ছে।  

বিআরটিসির একটি এসি বাসের কনডাক্টর রফিকুল ইসলাম বলেন, বাসগুলো পুরনো হয়ে গেছে। সবগুলো এসি কাজ করে না এটা সত্য। এরপর অতিরিক্ত যাত্রী না নিয়েও উপায় থাকে না। অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে গেলে এসিতে লোড নিতে পারে না। আর বাসগুলো প্রতিদিনই চলছে, তাই এসির কাজ করানোর জন্য গ্যারেজেও পাঠানো হয় না।  

আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থা ইউএনডিপি ও ইউএসএইডের অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের কারিগরি সহায়তায় এই ডিজিটাল (ইন্টারনেট) বাস সার্ভিস শুরু হয়। এটুআইয়ের জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাইমুজ্জামান মুক্তা এ বাস চালুর ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

সার্ভিসটির বর্তমান অবস্থা নিয়ে নাইমুজ্জামান মুক্তা বলেন, তাদের উদ্যোগে চালু করা এই ডিজিটাল বাসসেবাটিকে বিআরটিসি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেনি। ভেহিকল ট্র্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে লাইভ ট্র্যাকিংসহ আরো কয়েকটি সেবা চালুর কথা ছিল। কিন্তু ওই ওয়াইফাই ছাড়া আর কিছু হয়নি। এখন বাসগুলোর ওয়াইফাই সেবাও বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

বিআরটিসির পরিচালক (কারিগরি) কর্নেল মাহবুবুর রহমান বলেন, কয়েকটি বাসের ওয়াইফাই কাজ করছে না, এমন অভিযোগ আমাদের কাছেও আছে। কিন্তু এ সেবাটি আমাদের দিচ্ছে টেলিটক। আমরা টেলিটক কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, তারা কাজ করছে। আর এসি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লোড নিতে পারে। আমরা যে এসি বাসগুলো রাজধানীতে চালু করেছি, সেগুলো আসলে সিটিং সার্ভিসের জন্য কোম্পানি তৈরি করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তো সিটিং সার্ভিস করা সম্ভব নয়। বাসে যখনই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যায়, তখন এসিগুলো যথাযথ কাজ করে না। আর বেশ কয়েকটি বাসের এসি নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বাসগুলো আমাদের প্রতিদিন চালাতে হচ্ছে। তাই এগুলো মেরামত করার সময়ও পাওয়া যাচ্ছে না।  

এ প্রসঙ্গে বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, সংস্থাটিকে ক্রমান্বয়ে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে নতুন ৩০০ বাস যুক্ত হবে বিআরটিসিতে। এর মধ্যে ২০০টি ডাবল ডেকারে ১০০ নন-এসি বাস রয়েছে। এসব গাড়ি আনা হচ্ছে ভারত থেকে। আগামী অক্টোবরের মধ্যেই বাসগুলো আমরা পেয়ে যাব।

এ ছাড়া বিভিন্ন ডিপোতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা বিআরটিসির ১২০টি গাড়ি মেরামতকাজ চলছে। এ বাসগুলো চালু হলে সেবার মান কয়েক গুণ উন্নত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!