নতুন কাঠামোতে জামায়াত!

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৯, ০২:৫৭ পিএম
নতুন কাঠামোতে জামায়াত!

ঢাকা : অতীতে কয়েক দফায় সংস্কারের আলোচনা হলেও প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামীকে নতুন অবয়বে আনার প্রস্তাব করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্যরা। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করে বিতর্কে থাকা জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও গত ১০ বছরের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শূরা সদস্যরা এ প্রস্তাব করেন।

দলের বর্তমান সংগঠন ও কাঠামো ঠিক রেখে নতুন নামে নতুন সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদকে। এই সংগঠনের নাম, কাঠামো, ধরন নিয়ে এ কমিটি কাজ শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোকপাত হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সব দলেই সব সময় চিন্তা-ভাবনা থাকে। আমরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছি। তবে এখনও মৌলিক কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি জামায়াতে ইসলামী।’

জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার কয়েকজন সদস্য জানান, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান, উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর আচরণ এবং সর্বশেষ বিগত ১০-১২ বছর ধরে রাজনৈতিক যে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে জামায়াতকে যেতে হয়েছে, সেসব দিক বিবেচনা করে ‘জামায়াত’ হিসেবে রাজনৈতিক সাফল্য অনেকটাই সুদূরপরাহত। এক্ষেত্রে গত জানুয়ারির মাঝামাঝিতে কেন্দ্রীয় শূরা সদস্যদের পৃথক-পৃথক বৈঠক থেকে প্রস্তাব আসে, দলের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে। এ বিষয়ে দলের নির্বাহী কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের। গত মঙ্গলবার দিনে অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।

কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার একাধিক সদস্য জানান, জামায়াতে ইসলামী নামে যে দল আছে, তা ঠিক থাকবে। নতুন সংগঠন হবে প্রাথমিকভাবে অরাজনৈতিক। ইতোমধ্যে দলের গঠনতন্ত্রের ৬ ধারার ৪ উপধারা স্থগিত করা হয়েছে।  

নতুন এই সংগঠনের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীদের যুক্ত করা হবে। এছাড়া অন্যান্য দল থেকে আগ্রহী হলে তাদেরকেও যুক্ত করা হবে। গঠনতান্ত্রিকভাবে ৬ ধারার ৪ উপধারা স্থগিত করায় এই সংগঠনের মূল পরিচয় হবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক। নতুন এই সংগঠনে বর্তমান জামায়াতের পরিচিত কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে না।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার একজন সদস্য বলেন, ‘সব বিষয়ে জিনিয়াসরা নিশ্চয়ই থাকবেন। নিশ্চয়ই দ্রæততার সঙ্গে কাজ করবেন। নাম কী হবে, তা নির্বাহী পরিষদ ঠিক করবে।’

একাধিক শূরা সদস্য বলেন, ‘নতুন সংগঠন করতে মজলিসে শূরার সদস্যরা নির্ধারিত সময়সীমা বেঁধে দেননি। তারা প্রস্তাব করেছেন দ্রæততার সঙ্গে করতে।’

ছাত্র শিবিরের সাবেক একজন কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেন, ‘আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে প্রক্রিয়া শেষ করে আনা হবে।’

গত কয়েক বছরে জামায়াতের নতুন নামে আসার বিষয়টি আলোচনায় আছে। প্রথমবার আলোচনা হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে। ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল ‘বকুল’ থেকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি জামায়াতকে পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবালের সঙ্গে। প্রবাসে থাকা হাসান মনে করেন, ‘জামায়াতের নতুন নাম নিয়ে তো দলের বাইরে, ভেতরে অনেক আগে থেকেই আলোচনা আছে। আর আব্বার পরামর্শ তো ছিলই। দল তো সেটা নিয়ে পরবর্তীতে চিন্তা করেনি। এখন যদি উদ্যোগ গৃহীত হয়, সেটা চাপের মুখে কিনা সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই বর্তমান নেতৃত্ব ভাববেন।’

তবে নির্বাহী পরিষদের একজন প্রভাবশালী সদস্য বলছেন, ‘আমরা সবগুলো বিষয়ই ভাবছি। আমি মনে করি সেদিকে গেলে সেটা চাপের মুখে হবে না। কোনও চাপকে সামনে রেখে আমাদের ভাবনা আসছে না।’

২০১৬ সালেও নতুন নাম নিয়ে আলোচনা তৈরি হয় জামায়াতে। ওই বছর সরকারের পক্ষ থেকেও রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। চলতি বছরের এ মাসের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জামায়াতের রাজনৈতিক নিবন্ধনের বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন। তিনি আশা করেন দলটি নিষিদ্ধ হবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রয়োজনে আইন আবার সংশোধন করা হবে। জামায়াতের বিভিন্ন মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘জামায়াতের আপিল উচ্চ আদালতে পেন্ডিং আছে।’

আবুল আলা মওদুদীর হাত ধরে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে আবার প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত।

গত মঙ্গলবার সকালে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি। আইনি পথেই মোকাবিলা করবো। তবে আমার মনে হয় না, সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবে। জামায়াত দেশের প্রত্যেকটি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে।’

মজলিসে শূরার একাধিক সদস্য বলছেন, নতুন নামে নতুন সংগঠন গঠন করার প্রক্রিয়ায় জামায়াতের বিভিন্ন বিষয় যুক্ত থাকবে। বিশেষ করে দলের বর্তমান গঠনতন্ত্র নতুন সংগঠনে কোন প্রক্রিয়ায় কাজ করবে, দলের নীতি, স্থায়ী কর্মসূচি, স্থায়ী নীতি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার কাজ বাকি আছে। এছাড়া দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক জনশক্তিকে নতুন সংগঠনে কীভাবে নেওয়া হবে, এর রূপরেখাও তৈরি করতে হবে।

মজলিসে শূরার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদে পাঠানো হয়েছে বলে জানান জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরার সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, এখন তারাই ঠিক করবেন পরবর্তী সিদ্ধান্ত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘চিন্তা অনেকে করতে পারেন। রাজনৈতিক দল হলে কী গোপনে হয় নাকি। হলে আমরা বলবো। আমাদের কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। চিন্তা-ভাবনা তো একটি রাজনৈতিক দলে স্বাভাবিক ঘটনা। সিদ্ধান্ত হলে জাতি জানতে পারবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!