• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্লাটিলেট সংগ্রহে ছুটছেন স্বজনরা


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১, ০৪:০৭ পিএম
প্লাটিলেট সংগ্রহে ছুটছেন স্বজনরা

ঢাকা : করোনার প্রকোপ কমলেও বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। আর এই ডেঙ্গুর ধরন ভিন্ন হওয়ায় দ্রুত মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এতে আক্রান্ত রোগীর রক্তের প্লাটিলেট সংখ্যা দ্রুত কমে যায়। তাই ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাটিলেট সংগ্রহের চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় সব হাসপাতালে ব্যবস্থা না থাকায় প্লাটিলেট সংগ্রহের জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন রোগীর স্বজনরা।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তিন মাস ধরে প্লাটিলেটের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর ধরন বেশ মারাত্মক। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে সময় নষ্ট করলে জীবননাশের হুমকি তৈরি হচ্ছে। রোগীকে বাসায় চিকিৎসা না করানোর আহ্বানও জানিয়েছেন তারা।

তাদের পরামর্শ, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরে কোনোভাবেই বাসায় স্যালাইন নেওয়া যাবে না। কারন নতুন ধরনের এই ডেঙ্গুতে শরীরে পানির সংকট হচ্ছে, তেমনি ‘ফ্লুয়িড ওভারলোড’ অর্থাৎ, শরীরে বেশি পানির কারণেও রোগী মারা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) চেয়ারম্যান মো. আফতাব আলী শেখ জানান, সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, চলতি বছর ডেঙ্গুর সবচেয়ে ক্ষতিকর ধরণগুলোর একটি ডেনভি-৩ এ দেশের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এতে দ্রুত রোগীদের রক্তের প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সে কারণে আক্রান্তরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের হাসপাতালে নিতে হচ্ছে।

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত বুধবার রাজধানীর ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এগার বছরে শিশু তাহসিন রহমান। ডেঙ্গু শনাক্তের পর তার প্লাটিলেট এক লাখের ওপর থাকলেও কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তার প্লাটিলেট নেমে যায় ২৪ হাজারের নিচে। ফুসফুসে পানি চলে আসে। ফলে জরুরি ভিত্তিতে তাকে প্লাটিলেট দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

কিন্তু দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে প্লাটিলেট সংগ্রহ করা সম্ভব না। কারন আরো বেশ কয়েকজন রোগীর প্লাটিলেট সংগ্রহের জন্য তখন ডোনার অপেক্ষমাণ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত অন্য কোথাও থেকে প্লাটিলেট সংগ্রহের পরামর্শ দেন। তাহসিনের বাবা জিল্লুর রহমান ছুটে যান পুলিশ হাসপাতালে। সেখানেও বলা হয় একই কথা। পরে তিনি যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। সেখানেও ছিল একই পরিস্থিতি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর সেখান থেকে পরে প্লাটিলেট সংগ্রহ করেন তিনি।

ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক শওকত আলী জানান, গত তিন মাস ধরে তাদের হাসপাতালে প্লাটিলেট সংগ্রহের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পাওয়ার জন্যই এই চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। শওকত আলী বলেন, এক ব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য ৪ জন ডোনারের প্রয়োজন হয়। আর এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। সেই হিসেবে দিনে ৫ থেকে ৬ জন রোগীর জন্য প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে পারেন তারা।

রোগী বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরাও। ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার বলেন, এবারের ডেঙ্গুর সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক তীব্র। হাসপাতাল রোগীতে ঠাসা। সিট না থাকায় নতুন কেউ ভর্তি হতে পারছে না।

তিনি বলেন, এবার যেসব জটিলতা নিয়ে রোগী আসছে সেটা ২০১৯ সালে আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না, অথচ এবারে তাই বেশি দেখতে হচ্ছে। এর আগে দুই থেকে একটা রোগী ছিল এক্সপান্ডেড, কিন্তু এবারে শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশই এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু।

চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় ২০১৯ সালে। কিন্তু সেবার অন্তত পাঁচ থেকে ছয়দিনের আগে রোগীর অবস্থা জটিল হতো না। কিন্তু এবারে চট করেই রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবারে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বিরল নয়, বরং বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গুর এই ধরন নিয়ে।

শিশুদের ক্ষেত্রে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম, অর্থাৎ লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও হূৎপিণ্ডের জটিলতা তৈরি হতে সময় লাগছে না, দ্রুত রোগী শকে চলে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বুকে-পেটে পানি জমছে।

এবার ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে  স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখানে দুই হাজার ৩৮৪ জনের মধ্যে হাসপাতাল ছেড়েছেন দুই হাজার ২১৩ জন আর মারা গেছেন ১৩। আর বর্তমানে ভর্তি আছেন  ১৫৮ জন। তাদের মৃত্যুর ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর)।

এ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ও ডেঙ্গু ইউনিটের ফোকাল পারসন ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ন্যাশনাল গাইডলাইনে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিন্ড্রোমকে বিরল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এবারে সেটা আর বিরল নেই, এবারে সেটা খুবই কমন হয়ে গেছে। এবারে বরং ডেঙ্গু মাইল্ড কেস বিরল হয়ে গেছে, সব ডেঙ্গুই এক্সপান্ডেড।

ডেঙ্গু আক্রান্তরা এবার নানা ধরনের শারীরিক জটিলতাতে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানান ডা. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এবছরের ডেঙ্গু রোগীরা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই খুব খারাপ প্রেজেন্টেশন নিয়ে আসছে।

যেমন- পেটে-বুকে পানি চলে আসা, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, অতিরিক্ত বমি হওয়া, লিভার-গলব্লাডার ইনভল্ভ হয়ে যাওয়ার কারণে রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, হাসপাতালে যত ভর্তি রোগী রয়েছে, তার মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীরই এ অবস্থা। অথচ ২০১৯ সালে আক্রান্ত হবার ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে রোগীর অবস্থা খারাপ হতো। কিন্তু এবারে আক্রান্ত হবার দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনেই মধ্যেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

দেশে প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। তবে গ্রামের তুলনায় শহরে আক্রান্তের হার বেশি।

শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২৩২ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এ নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৯৭ জনে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১৮৭ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৫ জন।

প্রতিবেদনে বরা হয়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ রোগীই রাজধানীর বাসিন্দা। সবমিলিয়ে করোনাকালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ৫৯ জন মানুষ। ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৯০ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২০৭ জন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৫ হাজার ৪৬০ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৪ হাজার ২০৪ জন রোগী। ডেঙ্গুতে এ সময়ে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!