• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সমস্যার চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে আফগান সংকট


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২০, ২০২১, ০৩:২৪ পিএম
রোহিঙ্গা সমস্যার চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে আফগান সংকট

ঢাকা : বাংলাদেশের জন্য একটি গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের পর সমস্যাটি যে এত জটিল হয়ে উঠবে, তা অনেকের ভাবনায়ও ছিল না।

কিন্তু এর কিছুদিন পরই বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটি প্রত্যাবর্তন চুক্তি হওয়ায় মনে হয়েছিল দুই দেশের সমঝোতার মাধ্যমে কোনো ধরনের সংকট ছাড়াই বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে এবং সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হবে না।

কিন্তু চার বছরেও সমস্যাটির কোনো সুরাহা হয়নি। এর ওপর বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে আফগানিস্তান সংকট। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আফগানিস্তানে নিবন্ধ থাকায় রোহিঙ্গা সমস্যার চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাচ্ছে। এমনটাই মনে করছেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দুই শক্তিশালী দেশ ভারত ও চীনের নীরব ভূমিকাও প্রত্যাবাসন থেমে থাকার বড় একটি কারণ। যত দিন যাবে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া তত কঠিন হবে। মিয়ানমার তো অবশ্যই চাইবে না রোহিঙ্গারা ফিরে যাক। সেই ক্ষেত্রে তারা এক ধরনের সফল। কারণ চার বছর পর্যন্ত তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি আটকে রাখতে পেরেছে।

মিয়ানমারের রাখাইনেও তারা এমন পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে, যেন রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে ভয় পায়। তাই বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু করতে হবে।

বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, বাংলাদেশের একার প্রচেষ্টায় এই প্রত্যাবর্তন অনেক কঠিন হবে। কারণ মিয়ানমার একটা কঠিন পক্ষ। চীন ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

তারা বলছেন, মিয়ানমারের এই দুই প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারকে কোনো ধরনের চাপ দিচ্ছে না। তারা শুধু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সাধারণভাবে উৎসাহ জোগাচ্ছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা করতে হবে। তা না  হলে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে।

এদিকে গতকাল রোববার ফরেইন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে ডিপ্লোাম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ-ডিক্যাব আয়োজিত সংলাপে মিয়া সেপ্পো বলেন, রোহিঙ্গা সংকটকে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হিসেবে মনে করেন অনেকে। এটা বাস্তবতা যে, আফগানিস্তান এই সময়ে বড় রকমের মনোযোগ পাচ্ছে এবং তা এখানকার চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে।

নিজ বক্তব্যের ব্যাখ্যায় জাতিসংঘের দূত বলেন, দীর্ঘস্থায়ী কোনো সংকটে বৈশ্বিক মনোযোগ ধরে রাখা যে চ্যালেঞ্জের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন কোনো সংকট কক্সবাজারের মত দীর্ঘ মেয়াদি ও বড় রকমের সংকটের আকার পায়, তা নিরসনে সম্পদের যোগান দেওয়াও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

তার মতে, রোহিঙ্গা সংকট যাতে ভুলে যাওয়া কোনো ঘটনায় পরিণত না হয়, সেজন্য সবার দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় কাজ করছে। বাংলাদেশের বন্ধু, দাতাসংস্থা ও জাতিসংঘসহ অন্যদেরও এক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগাস্ট থেকে কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। এতে আগে থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাসহ মোট শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখের বেশি, জেলার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ এই রোহিঙ্গাদের খাবার ও আশ্রয়ের মত মৌলিক প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে আসছে গত চার বছর ধরে। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ততই কমে আসছে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চুক্তিতে সই করলেও তাদের প্রস্তুতির অভাব আর রোহিঙ্গাদের আস্থার সংকটে তা আর এগোয়নি।

যদিও কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার যে কার্যক্রম সরকার শুরু করেছে, তা নিয়ে শুরুতে আপত্তি থাকলেও এখন জাতিসংঘ সেই কার্যক্রমে যুক্ত হতে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে মিয়া সেপ্পো বলেন, আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। সরকারের উদ্যোগ ও এনজিওগুলোর সেবা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে জাতিসংঘ।

১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসান চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি জানান, যখনই সমঝোতা স্মারক সই হবে, তখনই আমরা এই কাজে সম্পৃক্ত হব। জাতিসংঘ কীভাবে এই কাজে সম্পৃক্ত হবে, তা ঠিক করতে কাজ চলছে এখন।

ভাসানচরের পরিস্থিতি নিয়ে মিয়া সেপ্পো বলেন, ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকার বিশাল বিনিয়োগ করেছে, যার লক্ষ্য ছিল ওই এলাকাকে বাসযোগ্য করা। শরণার্থী সুরক্ষা সংস্থা হিসেবে ইউএনএইচসিআরও তা চায়। সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করে বিশ্বব্যাংকের একটি কাঠামো প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মনে করি, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের শর্ত নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। শরণার্থীদের বিষয়ে তহবিল দিতে বিশ্ব ব্যাংকের একটি বৈশ্বিক কাঠামো আছে। এক্ষেত্রে সামাজিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও তাদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে থাকে, তার মানে এই নয় যে বিশ্বব্যাংক বা জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, জটিল রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নিজস্ব নীতি রয়েছে। সুতরাং বুঝতে হবে, সর্বব্যাপী একটি তহবিল ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবেই।

জাতিসংঘ যখন বলে সামাজিক সংহতি, তা সব সময় সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বোঝায় না। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যতক্ষণ বাংলাদেশে আছে, তারা ফেরার আগ পর্যন্তই বিষয়টি কার্যকর হবে।

আর বৈশ্বিক নীতির সংগে শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশের নীতি যে সব সময় মিলবে না, তুরস্ক, উগান্ডা, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশও যে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা আলাদাভাবে নিজেদের মত করে করেছে, সে কথাও বলেন মিয়া সেপ্পো।

তার মতে, ‘গ্লোবাল পলিসি সবার জন্য একইভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রিসোর্স মোবিলাইজেশনের জন্য ফান্ডিংয়ের দরকার।

বিশ্ব ব্যাংকের এই তহবিল রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সবারই উপকারে লাগতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা, এই সংলাপ চালু থাকবে। এটা সামাজিক সংহতির বিষয়, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নয়।’

তিনি বলেন, শরণার্থীদের জন্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের বড় অংশীদার ইউএনএইচসিআর। বৈশ্বিক নীতি তৈরির পেছনেও ইউএনএইচসিআর অংশীদার। আন্তর্জাতিকভাবে ভালো উদাহরণগুলো এই নীতির ভিত্তি।

কিন্তু বৈশ্বিক ও স্থানীয় নীতি বেশিরভাব ক্ষেত্রে একরকম হয় না, আর তখনই জটিলতা হয়। বৈশ্বিক নীতির ক্ষেত্রে আমরা বিশ্ব ব্যাংকের মতো একই অবস্থানে। কিন্তু বাংলাদেশে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আলোচনা প্রয়োজন। বৈশ্বিক নীতি ও স্থানীয় বাস্তবায়নের বিষয়কে আলাদা করে দেখতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!