• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
ভারতে শনাক্ত একশ’র বেশি রোগী

এবার জিকা ভাইরাস ঝুঁকিতে বাংলাদেশ


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ১৮, ২০২১, ১২:৫৭ পিএম
এবার জিকা ভাইরাস ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

ঢাকা : দিন দিন কমছে করোনা সংক্রমণ। কিন্তু এখনো অনিয়ন্ত্রিত ডেঙ্গু। এরই মধ্যে জিকা ভাইরাস প্রকোপ দেখা দিয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ইতোমধ্যে সে দেশে একশ’র বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও এই ভাইরাসের ভয়াবহ ঝুঁকির শঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, জিকা ভাইরাসের বাহক এডিস মশা। সেই একই মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালে জিকা শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই করোনা ও ডেঙ্গুর ব্যাপকতার মধ্যে জিকা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে দেখা দেবে মহাবিপদ। কারণ, জিকা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির দেহে ছড়ায়। তাই ভারতে ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে জিকা ভাইরাস দেশে আসার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে সিলেটে জিকার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। তখন স্বাস্থ্য বিভাগে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিমানবন্দর, নৌ-বন্দর, স্থলবন্দরসহ বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এরপর এ বিষয়ে আর কোনো দৃশ্যমান সতর্কতা চোখে পড়েনি। ব্রাজিলে ১৯১৫ সালে জিকা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে মহামারি ঘোষণা করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা জারি করেছিল।

বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, মশাবাহিত জিকা ভাইরাস অনেক বেশি ভয়ানক। জিকার লক্ষণ হলো; হালকা জ্বর, চোখে ব্যথা ও লালচে রঙ, মাথা ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা এবং শরীরে র্যাশ। এর ফলে স্নায়ু বিকল হয়ে যেতে পারে যাতে অস্থায়ী পক্ষাঘাত দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো গর্ভবতী নারী যদি এতে আক্রান্ত হন তাহলে তার শিশু মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত হতে পারেন। এতে শিশুর মাথা ছোট হয়।

অর্থাৎ তাদের মস্তিষ্ক সঠিক আকারের হয় না বা মস্তিষ্কের সঠিক বৃদ্ধি হয় না। এমন শিশুদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার অথবা দেরিতে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। জিকার কারণে ২০১৫ ও ১৬ সালের দিকে ব্রাজিলে চার হাজারের মতো শিশু এমন সমস্যা নিয়ে জন্মেছে।

এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখনো টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তাই চিকিৎসকরা বলছেন, যেহেতু এই রোগ মশাবাহিত, তাই এর প্রাদুর্ভাব রোধে অবিলম্বে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সেইসঙ্গে কারো শরীরে লাল বিন্দু দেখা দিলে, জ্বর জ্বর ভাব, মাথা ব্যথা, পেশীতে যন্ত্রণা, বমি ভাবের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, জিকা ভাইরাসের ঝুঁকি অবশ্যই রয়েছে। ভারতে যে সময় এই রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, ঠিক সেই সময় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব ধরনের ভ্রমণ ভিসা চালু হয়েছে। এটা অবশ্যই উদ্বেগের। এখনই যদি স্বাস্থ্য বিভাগ সতর্ক না হয়, সামনে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে। দেশে করোনা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। এর মধ্যে জিকা ভাইরাস দেখা দিলে সামাল দেওয়া কষ্ট হয়ে যাবে।

তার মতে, স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি কোনো কাজে আসে না। মহামারি করোনা ও ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি দেখিছি। তারা মুখে প্রস্তুতির কথা বললেও বাস্তবে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, শহর-গ্রামগুলোয় এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে।

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে এই ভাইরাস যদি বাংলাদেশে আসে, তাহলে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে। প্রতিবেশী নেপালেও এটি দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ বড় ঝুঁকিতে আছে। তাই বিমানবন্দরে জিকা ভাইরাস শনাক্তকরণ স্ক্যানিং মেশিন বসানোর আহ্বান জানান এই বিশেষজ্ঞ।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, দেশে প্রথম জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয় ২০১৩ সালে। এরপর আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিনিয়ত এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। বিমানবন্দরে স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

এদিকে, ভারতে এই ভাইরাস উদ্বেগজনক হারে বাড়লেও তেমন কোনো ঝুঁকি দেখছেন না আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ভারতে এর আগেও একবার জিকা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। তখনো আমরা এ বিষয়ে সতর্ক ছিলাম। যেহেতু এই ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তাই ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে জিকা পরীক্ষারও ব্যবস্থা রয়েছে।

তিনি জানান, আইইডিসিআর এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যদি জিকা ভাইরাসে নমুনা কারো দেহে শনাক্ত হয়, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইইডিসিআর এ বিষয়ে সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া রয়েছে। সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে।

এ এস এম আলমগীর জানান, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে মারা যায় না। তবে সমস্যা হলো ৯৫ শতাংশ মানুষ উপসর্গ ছাড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। আর একটি বড় সমস্যা হলো, এই ভাইরাসে যদি গর্ভবর্তী মা আক্রান্ত হন, তাহলে নবজাতকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, মাথার আকার ছোট হয়ে যায়। তবে আশার বিষয়, এখনো এখানে গত পাঁচ-ছয় বছরে কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।

গত সপ্তাহে জিকা সংক্রমণের কারণে ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশের কানপুরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিবিসি জানায়, শহরটিতে ১৭ শিশুসহ কমপক্ষে ৮৯ জন জিকা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। রোগীদের মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীও আছেন। চলতি মৌসুমে কানপুরে প্রথম জিকার সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত ২৩ অক্টোবর। আর উত্তর প্রদেশে জিকার সংক্রমণ শনাক্তের ঘটনা এটাই প্রথম।

কানপুরের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ড. নেপাল সিং জানিয়েছেন, শহরটিতে ক্রমেই বেড়ে চলেছে জিকা আক্রান্তের সংখ্যা। বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে নজরদারি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। আর উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথ জানিয়েছেন, কানপুরে জিকার বিস্তার দ্রুত বাড়ছে। এ অবস্থায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতামূলক কার্যক্রমের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে।

তিনি বলেন, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। প্রতিটি রোগীর স্বাস্থ্য আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভারতে জিকার সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৭ সালে, গুজরাটে।

তবে বিশ্বে জিকা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে উগান্ডায়। এটি প্রথম পাওয়া যায় এক প্রজাতির বানরের দেহে। ১৯৫৪ সালে মানবদেহে এটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিল নাইজেরিয়ায়। এরপর আফ্রিকাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের কিছু দ্বীপে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব হয়েছে ২০১৫ সালে ব্রাজিলে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!