ঢাকা: মিডিয়ার কল্যাণে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কী ঘটছে তা সাথে সাথে রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে। নিউজ সেন্সের কারণে একটা সাধারণ মাছিও সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। কেন হবে না? সে তো বসেছে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের মাথায়! তাও আবার ডিবেট চলাকালীন; নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে লেন্সে। আমাদের রিপোর্টে ইদানীং বেশি বেশি ধরা পড়ছে ধর্ষণ। দেশের কোনা-কানচি থেকে উঠে আসছে ধর্ষণ সংবাদ। কোথাও কোথাও ধর্ষক ধরা পড়ছে, কোথাও পড়ছে না। প্রতিদিনই চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রকাশ ঘটছে। এক ঘটনা এসে পূর্বের ঘটনাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। আস্তে আস্তে মানুষের মন থেকেও মুছে যায়। ফাঁকে ছাড়া পেয়ে যায় সুবর্ণচরের ধর্ষক।
মাছিরূপী ধর্ষকরা যত নিখুঁতভাবে ধরা পড়বে ততই লাভ। সমাজে চিহ্নিত হবে, মানুষ থু থু দেবে, বলবে ঐ দেখ, ধর্ষক যায়! তাদেরকে এড়িয়ে চলতে, তাদের থেকে সাবধান হতে সহায়তা করবে। মা-বোন-মেয়েরা নিরাপদে থাকবে। মাছি কেন? আগের লেখায় এক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেছিলাম যে, আমাদের দেশে প্রতি এক লাখে মাত্র ৯.৮২ জন ধর্ষক। সংখ্যায় এরা তো মাছির মতোই ক্ষুদ্র। এদের চিহ্নিত করা গেলে এড়িয়ে চলা ও দমন করা সহজে সম্ভব। মুশকিলটা হলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে। কারণ ধর্ষকদের কোনো জাত-পাত নাই, আত্মীয়তা নাই, নাই কোনো বাছ-বিচার। প্রতিবেশী তো দূরে থাক; আপন বাবা, আপন খালু, আপন চাচা, আপন ফুপা, আপন মামা—কে নাই তালিকায়? আছে ক্ষমতার দাপট, আইনের অপপ্রয়োগ! আছে লোকলজ্জার ভয়! সুতরাং, যত পারো চেপে যাও। বলুন, তাহলে চিহ্নিত হবে কী করে?
এ পর্যন্ত যতগুলো চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ সংবাদ সামনে এসেছে, তার প্রায় সবগুলো এসেছে মিডিয়ার কল্যাণে। এরপর ধরপাকড়, পুলিশি তৎপরতা, মিছিল-মিটিং, আন্দোলন চলে এবং চলছে! এগুলো যখন লিখছি তখন শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী বিশাল গণজমায়েতের ডাক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ তাতে বিন্দুমাত্র থামেনি। এ দিনের রিপোর্ট যদি উল্লেখ করি তবে তা স্পষ্ট হবে—যশোরে যাত্রীবাহী বাসে তরুণী গণধর্ষণের শিকার; বন্ধুর স্ত্রীর ধর্ষণের ভিডিও বিক্রি; স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে চাচা গ্রেপ্তার; গাজীপুরে স্কুলের ভেতর কিশোরী ধর্ষণ; চাঁদপুরে ১৩ দিন আটকে রেখে স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ; তিন শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে বাড়ির মালিক আটক; -এ যেন করোনার চেয়েও বড়, ধর্ষণের মহামারী!
আচ্ছা, এতো যে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে ধর্ষকদের কাছে সেগুলো কি যাচ্ছে না! ওরা কি পড়ছে না! শাহবাগের আন্দোলনের খবর কি ওদের কাছে গুরুত্বহীন! টিভিতে এত টক-শো, এত স্টোরি— ওরা কি দেখছে না! হ্যাঁ, জানলেই বা কী? বড় জোর কয়েক মাস বা বছর হাজতবাস, তারপর তো আবার! ওরা জানে ওদের কদর কাদের কাছে। জানে যে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা ঠিকই ওদের ছাড়িয়ে নেবে। কাউকে কাউকে নাঙ্গলকোটের ধর্ষক চাচার মতো ফুলের মালায় বরণ করে নেওয়া হবে। ওরাই তো ভবিষ্যৎ!
গণদাবি—ওদের ফাঁসি দেওয়া হোক। একটা অংশের দাবি ওদের castration বা খোঁজা (খাসিকরণ) করা হোক। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। আইনমন্ত্রীর বরাতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সন্দেহের জায়গা হচ্ছে এর প্রয়োগ নিয়ে। জানা মতে, পৃথিবীর ৮টি দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইরান, পাকিস্তান এবং উত্তর কোরিয়া। সৌদি আরবে শাস্তি কার্যকর করা হয় জনসমক্ষে কতল করে, আগে হতো পাথর মেরে। আফগানিস্তানেও জনসমক্ষে, তবে গুলি করে। উত্তর কোরিয়াতে ফায়ারিং স্কোয়াডে। চীনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পাশাপাশি অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী castration বা খোঁজা করাও হয়। ইন্দোনেশিয়ার কোনো কোনো প্রদেশেও খোঁজা করা হয়।
কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে আমরা এ ধরনের শাস্তি কার্যকর করতে কতটা সক্ষম হব? চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনায় আবেগ-আপ্লুত হয়ে মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলা যত সহজ আর তা আইন করে কার্যকর করা ততটা সহজ হবে কি! যেসব বুদ্ধিজীবী নামধারীরা এখন গণদাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছেন, তারাই আবার মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তির বিরোধিতা করবেন ইনিয়ে-বিনিয়ে। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হোক! তবে তা যেন সঠিক তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যকর হয়। ধর্ষকদের মনে যেন কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু আপাতত ধর্ষকরা না কাঁপলেও, কাঁপছে আমজনতা। আর চেয়ে আছে মৃত্যুদণ্ড এনে আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, সেদিকে।
তবুও কথা থেকে যায়, এতেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে। স্বজনপ্রীতি, অর্থ ও ক্ষমতার দাপট, রাজনীতিকরণ—ধর্ষকদের করে তুলেছে বেপরোয়া। এর রাশ টানতে হলে ধর্ষকদের সমাজ থেকে ছিন্ন করতে হবে। আর যে কাজটি করতে হলে দরকার ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আর এ দুটোর অনুপস্থিতি দুর্নীতির ঘূর্ণিপাকে ফেলে দেশটাকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। তবে আশার কথা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন যে, ‘ধর্ষণকারীদের জন্য রাজনৈতিক দল যেন আশ্রয়ের ঠিকানা না হয়’। আমরা সাধারণ জনগণ এটাকে কথার কথা হিসেবে দেখতে চাই না। দল থেকে যেভাবে দুর্নীতিবাজ, মাদক ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ অভিযান চলছে, তেমনি ধর্ষক নির্মূল অভিযান চলুক, এটাও হোক গণদাবি। শুধু চুনোপুঁটি নয়, রাঘব বোয়ালদেরকেও নির্মূল করতে হবে।
ধর্ষণের ঘটনা ঘটামাত্র মাইক পেন্সের মাথার মাছির মতো ধর্ষকদের দিকেও ফোকাস করতে হবে সকল মিডিয়ার। খুঁজে বের করে জনসমক্ষে নাম, পরিচয় প্রকাশ করতে হবে। ধর্ষণ মানেই জীবন শেষ নয়! কাজেই রুখে না দাঁড়ালে কোনো শাস্তিই ধর্ষকদের নিবৃত করবে বলে আশা করা যায় না, সঙ্গে যদি থাকে ক্ষমতার বলয়ে আশ্রয়-প্রশ্রয়। রুখে দাঁড়াতে হবে নির্যাতিত, নির্যাতিতের পরিবার, সমাজের আপামর সবার।
এখানেই কিন্তু শেষ নয়! পরিবার, সমাজ থেকে যতক্ষণ না মূল্যবোধ শেখানো হবে, যতক্ষণ না শেখানো হবে যে নারীরা অবলা নন, তাদেরও সমান অধিকার আছে, সম্মান আছে, শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান-বুদ্ধিতে তারাও পুরুষের সমান এবং সমকক্ষ; ততক্ষণ ধর্ষণ নির্মূল করা বাস্তবে যাবে কিনা সন্দেহ। নিজ পরিবারের বাইরে অন্য কোনো নারী বয়সভেদে আমার মায়ের সমান, বোনের সমান, মেয়ের সমান—এই বোধ জাগ্রত হলে তবেই ধর্ষণ নির্মূল হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : সাংবাদিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :