• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রেক্ষিত আজারবাইজান-আর্মেনিয়া শান্তিচুক্তি


আরমান শেখ নভেম্বর ২৩, ২০২০, ১২:৪৫ পিএম
প্রেক্ষিত আজারবাইজান-আর্মেনিয়া শান্তিচুক্তি

ঢাকা : মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ককেশাস অঞ্চলে তেলসমৃদ্ধ আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেড় মাস গড়িয়ে অবশেষে শান্তিচুক্তিতে স্থির হলো গত ১০ নভেম্বর। পুতিনের বৈরী আচরণ এবং মার্কিনিদের তুখোড় রাজনৈতিক চালে রাশিয়ার প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের সংখ্যা এখন খুবই কম। এর মাঝেই যদি পার্শ্ববর্তী বন্ধুত্বপূর্ণ দুই দেশের যুদ্ধের মাধ্যমে বহিঃশক্তিগুলোকে ককেশাস অঞ্চলে দাওয়াত দেওয়া হয়, তবে রাশিয়ার ঘুম হারাম হবারই কথা।

দেড় মাসের যুদ্ধে তিন তিন বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের মতো ঘটনার জন্ম দিয়ে যেখানে পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছিল, সেখানে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রবেশের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবেই, বিশেষ করে যখন এর মধ্যকার একটি দেশ তেলসমৃদ্ধ হয়। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন মুল্লুকে এসেছে নতুন বিচক্ষণ  রুশবিরোধী কর্ণধার, তাই পুতিন অনন্য নজির স্থাপন করে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিশ্চিত করলেন চমৎকার একটি শান্তিচুক্তি। ঐ চুক্তিকে টেকসই করতে তিনি উক্ত অঞ্চলে রাশিয়ান সেনা মোতায়েনও আবশ্যক করে দিয়েছেন। এতে শুধু চুক্তিই টেকসই হবে না, বরং দুই দেশের ওপর রাশিয়ান প্রভাব বৃদ্ধি পাবে এবং মাঠ পর্যায়ে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী হবে।

দশ নভেম্বর স্বাক্ষরিত আজারবাইজান-আর্মেনিয়া শান্তিচুক্তি কেন? লাভবান কে? উল্লেখ্য যে, এই চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর নির্ধারণ করা হলেও এর সময়সীমা শেষের ছয় মাস আগে কোনো পক্ষ আপত্তি না তুললে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চুক্তি আরো পাঁচ বছরের জন্য বর্ধিত হওয়ার বিধান এতে উল্লেখ রয়েছে। নয় দফার এই চুক্তির মূলভাব হলো আজারবাইজান তার নতুন অধিকৃত ৫টি সিটি, ৪টি শহর এবং ২৪০টি গ্রামের পাশাপাশি আরো নতুন কিছু অঞ্চলের দখল পাবে যেগুলো তারা যুদ্ধ করে স্বাধীন করেনি। তবে এই চুক্তির অন্যতম একটি বিষয় হলো, আজারবাইজান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক আর্মেনিয়ার আরেকপাশে অবস্থিত আজারবাইজানের ছিটমহল নকশিভানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার ভেতর দিয়ে স্থল যোগাযোগ তৈরি। আর্মিনিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া এই আজারি স্থল যোগাযোগব্যবস্থা করে দিতে হবে আর্মেনিয়াকেই এবং এর তদারকিতে থাকবে রাশিয়ান সীমান্তরক্ষী বাহিনী এফএসবি। ফলে আজারবাইজানের জন্য নকশিভানের যোগাযোগ ব্যয় এবং পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ অনেকটা কমে আসবে। এছাড়াও আর্মেনিয়ার ভেতর দিয়ে যাতায়াতের সুযোগে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনারও একটি ক্ষেত্র তৈরি হবে আজারিদের জন্য।

অনেকেই এই চুক্তিতে রাশিয়ার পাশাপাশি তুরস্কও সমানভাবে উপকৃত এবং সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবে বলে মনে করলেও রাশিয়া এই দাবি মানতে নারাজ। রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সেনাও মোতায়েনের আজারবাইজানি দাবিকে অস্বীকার করে রাশিয়া মঙ্গলবার সরাসরি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, চুক্তির কোথাও তুরস্কের সেনা মোতায়েনের কথা উল্লেখ নেই। তাছাড়া ১২টি উড়োজাহাজে করে ৯০টি ট্যাংক, ৩৮০টি যুদ্ধযানসহ ১৯৬০ জন সেনা চুক্তিতে উল্লিখিত সীমান্ত অঞ্চলে ইতোমধ্যেই পাঠিয়েছে রাশিয়া। তবে বুধবার রাতেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন, চুক্তি পর্যবেক্ষণে রাশিয়া-তুরস্কের যৌথ কেন্দ্রের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বুধবার সকালে। ফলে সীমান্তে নজরদারিতে রাশিয়ান সেনাদের সঙ্গে তুর্কি সেনারাও পর্যবেক্ষণে যোগ দেবে।

সেনা মোতায়েন ছাড়াও রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে তুরস্ক উক্ত অঞ্চলে যথেষ্ট প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে সামপ্রতিক যুদ্ধটির মাধ্যমে। ফলে রাশিয়াও চাইছে না তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তুরস্কের সেনা ঘাঁটি স্থাপিত হোক। কেননা, লিবিয়া ও সিরিয়ায় দুই পক্ষের অবস্থানই বিরপরীতমুখী।

এদিকে চুক্তির বিরুদ্ধে আর্মেনিয়ায় ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আর্মেনীয় প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের জন্য সংসদে আলোচনা শুরু করেছে। তবে সংসদে তারা সংখ্যালঘু হওয়ায় তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া চুক্তি সম্পন্নের মাধ্যমে রাশিয়ান সেনা সীমান্তে অবস্থান নেওয়ার পর চুক্তি লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ আর থাকছে না এখন।

এই চুক্তির মাধ্যমে সর্বাধিক উপকৃত হয়েছে রাশিয়া। তারা কোনো দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক খারাপ না করে নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে শান্তি স্থাপন করেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে সাবেক সোভিয়েতের এই দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সখ্যতা থাকলেও নাগর্নো-কারাবাখ সংঘাত, রুশ-জর্জীয় যুদ্ধ এবং কাস্পিয়ান সাগরের আইনি অবস্থান নিয়ে আজারবাইজান-রাশিয়া সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় এক সময়। কারাবাখ সংঘাতে প্রথমে রাশিয়া নিরপেক্ষ থাকলেও আজারবাইজানে আবুলফাজ এলচিবের রুশবিরোধী জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় এলে রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষাবলম্বন করে। এতদসত্ত্বেও চেচেন সংকটে আজারবাইজান রাশিয়ার পক্ষ নেয় এবং ২০০৭ সালের এক জরিপে দেখা যায় ৮০ ভাগ আজারবাইজানি রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে আগ্রহী। তবে ২০০৮ সালের জর্জিয়া যুদ্ধের কারণে এই সমর্থন ৫২ ভাগে নেমে আসে।

কিন্তু আজারবাইজানের ভারসাম্যপূর্ণ ও বহুমুখী রাষ্ট্রনীতি আজারবাইজানকে রাশিয়ার নিকট গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে দিন দিন। তারা যেমন সিএসটিতে যোগ দেয়নি, তেমনি অন্য বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর মতো ন্যাটোতেও যোগ দেয়নি এখন পর্যন্ত। রাশিয়ার বর্তমান নিরপেক্ষনীতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় রুশ-আজারি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব। বর্তমানে আজারবাইজানের আমদানি তালিকার প্রথমে এবং রপ্তানির চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে রাশিয়া। এছাড়াও কথিত আছে, আর্মেনিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্টের ‘রঙিন বিপ্লব’-এর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসাকে পুতিন ভালো চোখে দেখেন না। তদুপরি নিকোল পাশিনিয়ান আসার পর থেকে সংবাদপত্রে হস্তক্ষেপ হ্রাস এবং এনজিওগুলোর নিয়ন্ত্রণ কমানোর ফলে পশ্চিমা সংস্থাগুলোর দৌরাত্ম্য ও প্রচার-প্রসার এবং রুশবিরোধী লেখালেখি বেড়েছে আর্মেনিয়ায়। তদুপরি ককেশাসের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র আজারবাইজানে দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী হলো রুশজাতি। অন্যদিকে আর্মেনিয়াকে সরাসরি সমর্থন না দিলেও ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে আর্মেনিয়া-রুশ বলয় থেকে চাইলেও সহজে বের হতে পারবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

উপর্যুক্ত কারণগুলো ছাড়াও সর্বাধিক কৌশলপূর্ণ কারণ হলো, আজারবাইজানকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে সহায়তা করে তুরস্ক চেয়েছিল রাশিয়া আর্মেনিয়ার পক্ষে যাক এবং এর মাধ্যমে আজারবাইজান রুশ বলয় থেকে বেরিয়ে সম্পূর্ণ তুর্কি বলয়ে ঢুকে পড়ুক ভবিষ্যতের জন্যে। এই ঘটনা আন্দাজ করেই হয়তো চতুর পুতিন নিরপেক্ষ ভূমিকা নেয় এবং মাহেন্দ্রক্ষণে তুরস্ককে বাদ দিয়েই একটি চুক্তির মাধ্যমে নিজের অবস্থান এবং জনপ্রিয়তা দুই দেশেই মজবুত করে নেয়।

পরিশেষে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বড় ধরনের সংঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে বিশ্ব। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি শান্তিচুক্তি মনে হলেও এর প্রভাবে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে, একসময় পুরো নাগর্নো-কারাবাখই আজারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। যদিও এটি নির্ভর করছে রুশ-আজারি সম্পর্কের ওপর।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!